অন্য স্বাদের হরর কমেডি। প্রত্যাশা মেটাতে পারল কি ‘ভূত তেরিকি’? সিরিজ দেখে লিখছেন পরমা দাশগুপ্ত। 

 

 

প্রাসাদোপম এক বাড়ি। ভেঙেচুরে যাওয়া সেই পোড়ো বসতের আলো-আঁধারিতে বাস করে বেশ কয়েক জন। কেউ আঠেরো শতক, কেউ উনিশ শতক, কেউ বা বিশ শতকের মানুষ। থুড়ি, ভূত। ও হ্যাঁ, সঙ্গে কিছু মানুষও আছে। কেউ থাকে, কেউ যাওয়া আসা করে। এহেন ভূত-মানুষের যুগলবন্দির ঠিকানায় গিয়ে হাজির জ্যান্ত সিনেমাওয়ালারা। আসল ভূতদের নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে, তাদের বাস্তবটাকে তুলে ধরতে। সেই উদ্দেশ্য কি সফল হল শেষমেশ? ভূতেদের বেঁচে থাকার, থুড়ি, মরে থাকার গল্প কি ধরা গেল ক্যামেরায়? নাকি ভূতেদের অদ্ভুতুড়ে কীর্তিতেই ভেস্তে গেল সব প্ল্যান? সেই সব নিয়েই হাতে গরম সিরিজ ‘ভূত তেরিকি’ হাজির হইচইতে। 

 

 

 

 

কৌশিক হাফিজির পরিচালনায় সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিরিজের সৃজনশীল পরিচালনার ভার সামলেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। ‘বল্লভপুরের রূপকথা’র পর আরও এক হরর কমেডি বেরোল তাঁর ঝুলি থেকে। অন্য স্বাদের এই গল্পে ভূতেরা মোটেই শুধু ভয় দেখায় না। তারা ঝগড়া-গালিগালাজ করে, চুলোচুলি করে, গান গায়, নিশি ডাকে, মেতে ওঠে প্রেম-যৌনতায়। সঙ্গে আবার রীতিমতো সংগঠনও করে।

 

 

 

 

 

 

গল্পে স্বাধীন চিত্রপরিচালক সঞ্জয় লীলা ব্যানার্জি (দুর্বার শর্মা) ভূতেদের নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে সদলবলে হাজির হয় সেই পেল্লায় অট্টালিকায়। যেমনতেমন করে নয়, রীতিমতো ‘নিখিল বঙ্গ অদ্ভুতুড়ে সমিতি’, প্যারানরমাল সোসাইটি ইত্যাদির অনুমতিপত্র হাতে নিয়ে। সেই ভূতের বাড়িতেই আলাপ তিন প্রজন্মের তিন পেত্নীর সঙ্গে। আঠেরো শতকের বিষ্ণুপ্রিয়া ওরফে ভানুদিদি (আভেরী সিংহরায়), উনিশ শতকের রাজিয়া (দীপাণ্বিতা সরকার) এবং সত্তর দশকের সুকুমারী (ঐশ্বর্য সেন)। তারাই এ বাড়ির তথা তথ্যচিত্রেরও তিন প্রধান চরিত্র। সঙ্গে ট্রেনি ভূত কমলেশ (শৌনক কুণ্ডু), রাজিয়ার মানুষ প্রেমিক জয়ন্ত (দেবরাজ ভট্টাচার্য)।     

 

 

 

সঙ্গে অবশ্য আরও পেত্নী আছে, আছে কুট্টি ভূতের দল, আছে ফাইফরমাস খাটা জ্যান্ত মানুষও। কিন্তু ভূতেদের নিয়ে শ্যুটিং করা কি এতই সোজা? তাই ঠিক কী কী ঘটল জানতে হলে পাঁচ পর্বের সিরিজটা দেখতে হবে। 

 

 

 

 

 

প্রথম এক-দুটো পর্বে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ খানিকটা ছায়া ফেলে অবশ্য। তারপর সিরিজ এগিয়ে যায় তার নিজের পথে, নিজস্ব প্লট-সাবপ্লটের অলিগলি পেরিয়ে। প্রথম দিকে খানিক ঢিমেতালে এগোলেও গতি আসে তৃতীয় পর্ব থেকেই। স্যাটায়ার-ধর্মী মজাদার সংলাপে সমকালীন সমাজ, বাস্তবের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি থেকে রাজনীতির ময়দান, সবটাই ছুঁয়ে গিয়েছেন অনির্বাণ-কৌশিক। অনির্বাণ-দেবরাজের কথায় ও সুরে গানগুলোও বেশ। ভুতুড়ে বাড়িতে অশরীরী কাণ্ডকারখানার সিনেম্যাটোগ্রাফি, ভিএফএক্স কিংবা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও জমজমাট।

 

 

 

 

 

এ সিরিজে অভিনয় করেছেন যাঁরা, থিয়েটারের মঞ্চ কিংবা সিরিয়াল পাড়া তাঁদের অনেককেই অনেকদিন চেনে। ফলে এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়। ইন্ডিপেনডেন্ট ডিরেক্টরের সংগ্রাম থেকে সৃজনশীলতা, আনন্দ থেকে হতাশা, সবটাই জম্পেশ দুর্বারের জমাটি অভিনয়ে। আভেরী কিংবা ঐশ্বর্য যখন দুই প্রজন্মের বাঙালিয়ানার টক্করে দুরন্ত, দীপাণ্বিতা যেন জীবন্ত করে তুলেছেন পলাশীর যুদ্ধের সময়কালের নবাবী আমলকে। জয়ন্তর ভূমিকায় দেবরাজ যথারীতি অসাধারণ। ট্রেনি-ভূত কমলেশ হয়ে মন কেড়ে ছাড়েন শৌনকও। বাকিদের মধ্যে নিশি ডাকা লবঙ্গ পিসি কিংবা কনিষ্কও বেশ মিষ্টি ভূত কিন্তু! 

 

 

 

 

 

এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু গোলমাল হয়ে গেল মোক্ষম দুটো জায়গায়। এক, গোটা সিরিজটা যেন স্রেফ একেক জন পেত্নীকে ধরে ধরে তার অতীত কিংবা স্বভাব জেনেই কাটিয়ে দিল। তার বাইরে গল্প এগোল না তেমন। এবং তাতেও আবার বিষ্ণুপ্রিয়া কী দোষ করল, বোঝা গেল না। কারণ তার একাকিত্বের গল্পটা যে ফাঁসই হল না! নেপথ্যে পাঁচ পর্বের সিরিজ শেষ করার তাড়াহুড়ো নাকি বাজেটের গুঁতো, তা তেনারাই জানেন!    

  

 

 

 

 

দুই, ভূতেদের বাস্তব তুলে ধরতে গিয়ে বড্ড বেশি প্রাধান্য পেয়ে গিয়েছে তাদের শরীরী চাহিদার দিকটা। সেটা কিছুটা ক্লান্তিকর লাগে কোথাও কোথাও। আর ওটিটি সিরিজের ধারা মেনে গালিগালাজও আছে খানিক। তা না থাকলেও খুব কিছু সমস্যা বোধহয় হত না। ভূতেরা সত্যি সত্যি গালি দেয় কিনা জানা নেই। প্রাপ্তি বলতে, এই সূত্রে প্রাচীন বাংলার কিছু অশ্রাব্য শব্দ দর্শকের শব্দভাণ্ডারে ঢুকে পড়ল হয়তো। কিন্তু সব মিলিয়ে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ কিংবা ‘বল্লভপুরের রূপকথা’র মতো নির্মল হাস্যরসের জমাটি ভুতুড়ে গল্প হয়ে উঠল না ‘ভূত তেরিকি’।    

 

 

 

 

টিজার কিংবা ট্রেলার দাগ কেটেছিল বেশ। মনে হয়েছিল, দুরন্ত কিছুই আছে ঝুলিতে। আশা না পুরিল। এই আর কী!