উদ্দালক: রমাপদ চৌধুরীর গল্প 'ভারতবর্ষ' নিয়ে সম্প্রতি মঞ্চ প্রযোজনা করল অশোকনগর নাট্যমুখ। প্রথমত এই কথা বলা জরুরি, গল্পটি চিরকালীন সমস্যা নিয়ে কথা বলে। কথা বলে পেশা পরিবর্তন ও ভিক্ষাবৃত্তির সমস্যা নিয়ে, যা বিভিন্ন আকারে, বিভিন্ন শ্রেণিতে, বিভিন্ন সময়ে ফিরে ফিরে এসেছে। সেই কারণে, গল্প দীর্ঘদিন আগে লেখা হলেও বিষয়টি কিন্তু আজীবন থেকে যাবে সমসাময়িক। তবে এই গল্পের প্রেক্ষিতে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গল্প থেকে উদ্ধৃত করতে ইচ্ছা করে। কয়েকটি লাইন। মানিক লিখছেন, 'ও, হ্যাঁ বাবু, হ্যাঁ। আমি জানি কেন ছিনিয়ে খায়নি, শুধু আমি, একমাত্র আমিই জানি। কেউ জানে না আর। আপনার মতো অনেক বাবুকে শুধিয়েছি, তারা সবাই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এটা-সেটা বলেন, বড় বড় কথা। আবোল-তাবোল লম্বাচওড়া কথা। আসল ব্যাপারে সেরেফ ফাঁক। বোঝেন না কিছু, জানেন না কিছু বলবেন কী। এক বাবু বললেন, বেশিরভাগ তো গরিব চাষি, নিরীহ গোবেচারা লোক, কোনোকালে বেআইনি কাজ করেনি। লুট করে কেড়ে নিয়ে খাবার কথা ওরা ভাবতেও পারে না। শুনলে গা জ্বলে বাবু। সাধ যায় না, চাছা গালে একটা থাপড় দিয়ে কানডা মলে দিতে? বেআইনি কাজ, বেআইনি! যে জানে মরে যাবে কেড়ে না খেলে, সে হিসেব করেছে কাজটা আইনি না বেআইনি, ছিনিয়ে খেলে তাকে পুলিশ ধরবে, তার জেল হবে।' গল্পের নাম, 'ছিনিয়ে খায়নি কেন'। কেন এই প্রসঙ্গ, জানেন? নাটকটি দেখলে বুঝতে পারবেন, কেন!
অশোকনগর নাট্যমুখ দীর্ঘদিন ধরে যে প্রযোজনা করে আসছে, সেখানে থাকে জীবন, সমাজ ও অস্তিত্বের প্রাথমিক প্রশ্নগুলি। এই নাটকেও তার অন্যথা হয়নি। বরং, সেটাই এসেছে মূলগত প্রশ্ন হিসাবে। নাটকের গল্পটা নতুন করে বলার কিছু নেই, যে কেউ চাইলেই এই গল্প পড়ে নিতে পারেন, অনেকে জানেনও। কিন্তু কী ভাবে সেই গল্পকে শিড়দাঁড়ার জোরের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যায়, তা নাট্যমুখ ভাবতে পেরেছে। ভাবতে পেরেছেন পরিচালক অভি চক্রবর্তী। উল্লেখ্য, এই নাটক লেখার পাশাপাশি, আলো, মঞ্চ, পোশাকও তাঁর ভাবনার ফসল। তিনি নিজে অভিনয় করেছেন সনাতন চরিত্রে। যেটি নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র। যাঁর মধ্যবিত্ত টানাপোড়েন, মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে ফিরে-ফিরে আসা দ্বন্দ্ব, সব নিয়ে বহুস্তরীয় চরিত্রটি পরিচালক ফুটিয়ে তুলেছেন অনবদ্য কৌশলে।
গল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন অমিত সাহা। মাহাতো চরিত্রে তাঁকে দেখে যেন মনে হয়, রেললাইন প্রান্তের সেই গ্রামকে শরীরে তুলে এনেছেন মঞ্চে। মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার তীব্র লড়াই, শিড়দাঁড়া সোজা রাখার মরিয়া লড়াইয়ে অমিত নিজেকে তুলে নিয়ে গিয়েছেন অন্যস্তরে। পাশাপাশি, বেহারীর ভূমিকায় গৌতম বসু, ভগবতী চরিত্রে দীপ্তসি সাহা ছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে শ্রেয়া সরকার, সুকান্ত পাল, অরূপ গোস্বামী, সায়ন পূজা যথাযথ ভূমিকা পালন করেছেন।
নাটকের মঞ্চ নির্মাণ করেছেন অরুণ মণ্ডল। যে ভাবনাকে তিনি বাস্তবে রূপ দিয়েছেন, তা অনবদ্য ও সমসাময়িক। আসলে নাটকটি কী বলতে চায়, অভিনয় দেখতে দেখতে মঞ্চের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালে তা আরও স্পষ্ট হবে ও পরিস্কার হবে। এই নাটকে বড় ভূমিকা পালন করেছেন রূপসজ্জার মনোজ হালদার। পশ্চিম প্রান্তের এই মানুষগুলো একেবারে দেহাতি। তাঁদের চেহারায় সেই দেহাতি চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে বের হয়। শহুরে কলকাতার চাকচিক্যে তাঁকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা কঠিন কাজ। মনোজ সেই কাজটি করেছেন সাফল্যের সঙ্গে। এই নাটকের আলোক প্রক্ষেপণ করেছেন সাহেব সান্য়াল। নাট্যমুখের সঙ্গে তাঁর কাজের ধারাবাহিকতা ও বোধের সম্মেলনে এই নাটকের তাঁর কাজ ভাষা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
নাট্যমুখের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, এই নাটক তাঁরা কেবলমাত্র দলের নিজস্ব স্পেস অমল আলো-তেই অভিনয় করবেন। দলের নিজস্ব অভিনয় হিসাবে তাঁরা অন্য কোথাও এই নাটক করবেন না। এই সিদ্ধান্তও আসলে নাটকের নিজস্ব রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। যদি কোনও কারণে পরবর্তীতে এই নাটক নিজস্ব উদ্যোগে মঞ্চে অভিনয় করতেও হয়, তাহলেও শুরুতে এই সদর্প ঘোষণা কিন্তু চিনিয়ে দিচ্ছে অদৃশ্য মেরুদণ্ডকে। যে মেরুদণ্ড নিয়ে ইদানিং অনেকেই লজ্জায় পড়েন, প্রকাশ্যে বা ব্যক্তিগত পরিসরে।
