আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিশ্বে খুব কম রাষ্ট্রই তাদের পারমাণবিক ক্ষমতাকে এমন এক জটিল ও উন্নত স্তরে পৌঁছাতে পেরেছে, যাকে বলা হয় নিউক্লিয়ার ট্রায়াড। এই ট্রায়াড বলতে বোঝানো হয় তিনটি ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপের ক্ষমতা— ভূমিভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র, সাবমেরিন থেকে ছোড়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং কৌশলগত বোমারু বিমান। এই তিনমুখী সক্ষমতা অর্জন করতে প্রয়োজন বহু দশকের প্রযুক্তিগত গবেষণা, বিপুল আর্থিক বিনিয়োগ এবং স্পষ্ট সামরিক কৌশল। তাই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ থাকলেও পূর্ণাঙ্গ নিউক্লিয়ার ট্রায়াডের মালিক দেশ খুবই কম। আজও বিশ্বের সামরিক শক্তির ভারসাম্য এই ট্রায়াডধারী রাষ্ট্রগুলোর ওপরই মূলত নির্ভরশীল।
নিউক্লিয়ার ট্রায়াডকে সবচেয়ে টেকসই প্রতিরোধব্যবস্থা হিসেবে ধরা হয়। কারণ, প্রথম আঘাতে যদি ট্রায়াডের একটি অংশ ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলেও বাকি দুই অংশ যথেষ্ট প্রতিশোধমূলক আঘাত হানতে সক্ষম। ভূমিভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র দ্রুত প্রতিক্রিয়া ও প্রস্তুতির সুবিধা দেয়, সাবমেরিন নিশ্চিত করে গোপনীয়তা ও অদৃশ্যতা, আর বোমারু বিমান দেয় নমনীয়তা ও লক্ষ্য পরিবর্তনের ক্ষমতা। এই কারণে যেসব দেশ পূর্ণাঙ্গ ট্রায়াড পরিচালনা করে, তারা তিনটি ক্ষেত্রেই ধারাবাহিকভাবে আধুনিকীকরণ কর্মসূচি চালিয়ে যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল শীতল যুদ্ধের সময় প্রথম দেশ, যারা পূর্ণাঙ্গ নিউক্লিয়ার ট্রায়াড মোতায়েন করে। ভূমি-প্ল্যাটফর্মে রয়েছে মিনুটম্যান-৩ আইসিবিএম, সমুদ্রপথে আছে ওহাইও-শ্রেণির ব্যালিস্টিক সাবমেরিন, যেগুলো ট্রাইডেন্ট–২ ক্ষেপণাস্ত্রে সজ্জিত। আকাশপথে ব্যবহৃত হয় বি–৫২এইচ ও বি–২ বোমারু বিমান, যেগুলো পারমাণবিক বোমা ও ক্রুজ মিসাইল বহনে সক্ষম। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তিনটি ক্ষেত্রেই বড় ধরনের নবায়ন করছে— সেনটিনেল আইসিবিএম, কলাম্বিয়া-শ্রেণির সাবমেরিন এবং ভবিষ্যৎ বোমারু বিমান বি–২১ এর মাধ্যমে।
রাশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের মালিক এবং একটি পূর্ণাঙ্গ ও সক্রিয় ট্রায়াড পরিচালনা করে। স্থলভাগে রয়েছে মোবাইল ও সিলো-ভিত্তিক আইসিবিএম— যেমন আরএস–২৪ ইয়ার্স ও সারমাত। সমুদ্রপথে মোতায়েন রয়েছে বোরেই-শ্রেণির সাবমেরিন, যেগুলো বুলাভা এসএলবিএম বহন করে। আকাশপথে ব্যবহৃত হয় টু–৯৫এমএস এবং টু–১৬০ বোমারু বিমান। রাশিয়া তাদের প্রতিরক্ষা নীতির কেন্দ্রে পারমাণবিক প্রতিরোধকে বরাবরই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে।
চীন সাম্প্রতিক দশকে দ্রুতগতিতে তাদের পূর্ণাঙ্গ ট্রায়াড তৈরি করেছে। স্থলভাগে রয়েছে ডিএফ–৪১ সহ বিভিন্ন মোবাইল আইসিবিএম। সমুদ্রপথে আছে জিন-শ্রেণির ব্যালিস্টিক সাবমেরিন, যেগুলো জেএল–২ এবং জেএল–৩ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারে। আকাশপথে রয়েছে এইচ–৬ বোম্বার এবং উন্নয়নাধীন পরবর্তী প্রজন্মের এইচ–২০। চীন বর্তমানে ওয়ারহেডের সংখ্যা বাড়াচ্ছে এবং সাবমেরিন থেকে দ্বিতীয় আঘাত হানার ক্ষমতা শক্তিশালী করছে।
ভারত সম্প্রতি নিউক্লিয়ার ট্রায়াড সম্পূর্ণ করেছে। স্থলভাগে রয়েছে অগ্নি-শ্রেণির ক্ষেপণাস্ত্র, আকাশপথে রয়েছে পারমাণবিক সক্ষমতাসম্পন্ন যুদ্ধবিমান। তবে সমুদ্রভাগে ট্রায়াড পূর্ণতা পায় আইএনএস অরিহন্ত-এর মাধ্যমে, যা পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে সক্ষম। ভারত বিশ্বের বিরল সেই রাষ্ট্রগুলোর একটি, যারা ট্রায়াডের পাশাপাশি ‘নো ফার্স্ট ইউজ’ নীতি ঘোষণা করে রেখেছে।
ট্রায়াড অর্জনে চেষ্টা চালাচ্ছে আরও কিছু দেশ। ফ্রান্স-এর সাবমেরিন ও বিমানভিত্তিক সক্ষমতা আছে, কিন্তু স্থলভিত্তিক পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র তারা ১৯৯০-এর দশকে প্রত্যাহার করেছে। যুক্তরাজ্য সম্পূর্ণভাবে সাবমেরিনভিত্তিক পারমাণবিক প্রতিরোধের ওপর নির্ভরশীল। উত্তর কোরিয়া স্থলভাগে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং এসএলবিএম পরীক্ষা করেছে, কিন্তু এখনো পূর্ণাঙ্গ ট্রায়াড পরিচালনা করে না।
বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান কাঠামোয় নিউক্লিয়ার ট্রায়াডধারী এই রাষ্ট্রগুলিই সামরিক শক্তির আসল নির্ধারক— আর তাদের প্রতিনিয়ত উন্নয়ন বিশ্বের নিরাপত্তা সমীকরণকে আরও জটিল করে তুলছে।
