চার বছর পরে পর্দায় ফিরল ‘ফ্যামিলি ম্যান’। কতটা পারদ চড়াল সিজন থ্রি? দেখলেন পরমা দাশগুপ্ত। 


চার-চারটে বছর কম তো নয়! মাঝে কত জল গড়িয়ে যায় আরব সাগর হয়ে। বয়স বাড়ে, দায়িত্ব বাড়ে। বদলে যায় আবেগের গ্রাফ। পাল্টে যায় শরীর-মনের ক্ষমতা। ‘ফ্যামিলি ম্যান’ ওরফে শ্রীকান্ত তিওয়ারি কি তার ব্যতিক্রম হবে? হয়ওনি স্বাভাবিকভাবেই। আর সেটাই আরও মনের মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছে অ্যামাজন প্রাইমের এই জনপ্রিয় সিরিজের সিজন থ্রি-কে। তবে হ্যাঁ, একটা জিনিস কিন্ত বদলায়নি। দেশের এবং পরিবারের সুরক্ষার স্বার্থে ঝুঁকি নেওয়ার খিদেটা শ্রীকান্তের এখনও এক্কেবারে একইরকম।


চার বছরের অধীর অপেক্ষা পেরিয়ে নতুন সিজন মুক্তি পেতেই নেটপাড়া তোলপাড়। কেউ বলছেন, সিজন থ্রি আরও বেশি ভাল, কেউ বলছেন আগের সিজনগুলোর চেয়ে কমজোরি। কেউ বেশি নম্বর দিচ্ছেন থ্রিলারের রুদ্ধশ্বাস প্লটকে, কেউ বা বলছেন শ্রীকান্তের পারিবারিক বাঁধন আরও মজবুত হওয়াটা মন কাড়ছে বেশি। তবে একটা বিষয়ে প্রত্যেকেই একমত, তুখোড় অভিনয় এবং সিনেম্যাটোগ্রাফিতে এবারেও এক মুহূর্ত স্ক্রিন থেকে চোখ সরাতে দিচ্ছেনা ‘ফ্যামিলি ম্যান থ্রি’।


ওটিটি-কাহিনির দুনিয়ায় উত্তর-পূর্ব ভারত আপাতত জটায়ুর ভাষায় যাকে বলে ‘সেলিং লাইক হট কচুরিস’। ‘ফ্যামিলি ম্যান’-এর নতুন সিজনেও তাই ডেস্টিনেশন নর্থ-ইস্টেই ভরসা রেখেছেন ক্রিয়েটর জুটি রাজ অ্যান্ড ডিকে। এবারের গল্পের কেন্দ্রবিন্দু নাগাল্যান্ড। স্পাই থ্রিলারের চেনা পথ ধরে যে গল্প ক্রমশ ডালপালা মেলেছে দিল্লি, মুম্বই, মায়ানমার, ইসলামাবাদ হয়ে লন্ডন পর্যন্ত। পাহাড়-জঙ্গল-জলপ্রপাতে ঘেরা চোখ জুড়োনো লোকেশন থেকে দেশবিদেশের ঝাঁ-চকচকে শহর— সবেতেই দুরন্ত সব দৃশ্যায়ন। প্রথম পর্বের শুরুতে নাগা পরবের উদযাপনে বোমা বিস্ফোরণ থেকে শেষ পর্বের জমাটি অ্যাকশন দৃশ্য, পুরোটাই যেন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। গোটা সিরিজ জুড়ে আঞ্চলিক গানের স্বাদও আলাদা মাত্রা জোড়ে।

 


গল্পের শুরুতেই কোহিমায় কেন্দ্রের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক চুক্তি সাক্ষরের মুখে দাঁড়িয়ে নাগাল্যান্ডের বিভিন্ন রেবেল গ্রুপ। কেন্দ্রীয় ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি এনআইএ-প্রধান গৌতম কুলকার্নির (দলীপ তাহিল) সঙ্গে সেখানেই হাজির টাস্ক-এর সুদক্ষ এজেন্ট শ্রীকান্ত (মনোজ বাজপেয়ী)। নির্বাচনে জিতে গদিতে ফেরার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী প্রণীতা বসুর (সীমা বিশ্বাস) পাখির চোখ প্রোজেক্ট সাহাকার নাগাল্যান্ডে উন্নয়ন, শিক্ষা, কর্মসংস্থানের জোয়ার আনতে চায়। তারই অঙ্গ এই চুক্তি। আর তার জন্য আপাতত স্থগিত লন্ডন-প্রবাসী ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট দ্বারকানাথের (যুগল হংসরাজ)সঙ্গে বিপুল টাকার আর্মস ডিল। কিন্তু মায়ানমার সীমান্তে যুদ্ধপরিস্থিতি, চিনা ষড়যন্ত্রের সহজ টার্গেট, বিদ্রোহ-ধস্ত, অশান্ত নাগাল্যান্ডে এভাবে শান্তি ফেরানো কি সম্ভব? তা নিয়ে সরকারি বৈঠক থেকে ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির অন্দরে সংশয়ের মাঝে চুক্তির আগেই কনভয়ে হামলা। ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় এনআইএ চিফ কুলকার্নি এবং প্রবীণ নাগা নেতা ডেভিড খুজোওয়ের। প্রাণে বেঁচে ফেরে একা শ্রীকান্ত।

 

ইতিমধ্যে দর্শক সমান্তরালে দেখতে থাকেন কীভাবে উত্তরপূর্ব ভারতে অশান্তি জিইয়ে রাখতে ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে লন্ডন থেকে ইসলামাবাদ। কীভাবে মোহময়ী ইন্টারন্যাশনাল ব্রোকার মীরা এস্টনের (নিমরত কওর) হাত ধরে পরপর খুনের ‘সুপারি’ এসে পৌঁছচ্ছে নাগা ড্রাগ লর্ড রুকমানগধা ওরফে রুকমার (জয়দীপ অহলওয়াত)কাছে। 
কুলকার্নি এবং ডেভিডের হত্যার দায় গিয়ে পড়ে বিদ্রোহী তরুণ নেতা, ডেভিডের নাতি স্টিফেনের উপরে। এদিকে সেরে ওঠার পরে শ্রীকান্তের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে আততায়ী রুকমার মুখ। পিতৃসম গুরুর হত্যার প্রতিশোধ নিতে উঠেপড়ে লাগে সে। তারই জেরে এক পুলিশি অভিযানে হবু স্ত্রী নিমাকে হারিয়ে শ্রীকান্তকে শেষ করে দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে রুকমাও। এসবের মাঝে কুলকার্নির মৃত্যুতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সন্দেহ গিয়ে পড়ে শ্রীকান্তের উপরেই। তার বিরুদ্ধে প্রমাণ মেলার পাশাপাশি দেশদ্রোহিতার অভিযোগে, ট্রোলে, বুলিইংয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতে থাকে শ্রীকান্তের স্ত্রী সুচিত্রা (প্রিয়ামণি), মেয়ে ধৃতি (অশ্লেষা ঠাকুর) ও ছেলে অথর্বের (বেদান্ত সিনহা) জীবনও। আর সেটাই ধস্ত করে দিতে থাকে শ্রীকান্তকে। ক্রমশ সে আঁচ করে তার নিজের কাজের পরিসরেই রয়েছে কোনও বিশ্বাসঘাতক। 

 

নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে আসল দোষীদের খুঁজে নিতে পারবে কি শ্রীকান্ত? পুরো ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে আসলে কারা এবং কেন? কীভাবে কাটবে রহস্যের জট? তা নিয়েই এগিয়েছে সাত পর্বের টানটান সিজন। যার পুরোটাতেই শ্রীকান্তের ছায়াসঙ্গী তার কোর টিম। বিশেষত জে কে তালপাড়ে (শরিব হাসমি) এবং আর্মির ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের অফিসার সালোনি ভাট (গুল পনাগ)।

 

এবারের কাহিনিতে তুখোড় এজেন্ট শ্রীকান্ত আরও অনেকটাই ফ্যামিলি ম্যান। ক্রমশ বড় হয়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বন্ধুর মতো খুনসুটিতে মাতে, মা-বাবার বিচ্ছেদের দিকে গড়াতে থাকা দাম্পত্যের সত্যিটা জানার পরে তাদের মনের দোলাচল সামলায়। ঘনিয়ে আসা ঝড়ের মুখে আগলে রাখে গোটা পরিবারটাকে। একইসঙ্গে অবিচল থাকে নিজের লক্ষ্যেও। আর এই গোটা সফরটাকেই যথারীতি ভীষণরকম জীবন্ত করে তোলেন মনোজ। ভাবলেশহীন মুখে বুদ্ধির লড়াই কিংবা পরিবারের বিপদে মনের ভিতর ভাঙচুর— সবেতেই একই রকম বিশ্বাসযোগ্য হয়ে। তাঁকে প্রতি মুহূর্তে যোগ্য সঙ্গত দিয়ে চলেন বাকি অভিনেতারা। সে কমিক টাইমিংয়ে শরিব-ই হোন বা দায়িত্ববান সহকর্মীর ভূমিকায় গুল পনাগ কিংবা পারিবারিক বৃত্তে প্রিয়ামণি-অশ্লেষা-বেদান্তরা। চোখ ঝলসানো স্মার্টনেস আর লাস্যের যুগলবন্দিতে, শানিত চতুরতায় যথারীতি পাল্লা দেন নিমরতও। এবং জয়দীপ! মাদক পাচার চক্রের মাথা থেকে নির্মম সুপারি কিলার কিংবা একটু একটু করে নিহত প্রেমিকার একরত্তি সন্তানের সঙ্গে স্নেহের বাঁধনে বাঁধা পড়ে যাওয়া— পুরোটাই কেমন অবলীলায় যে বাস্তব করে তোলেন! 

 

তবে হ্যাঁ, এবারের সিজনে ক্রমাগত টাইমলাইনের বদল, প্লটের একের পর এক শাখাপ্রশাখা, অজস্র চরিত্রের আনাগোনা কোথাও কোথাও যেন শ্লথ করে দেয় গল্পের গতি, বিশেষত শুরুর দিকে। কোন ঘটনার জের কখন কোথায় গিয়ে পড়ছে, খানিকটা গুলিয়েও যায় মাঝেসাঝে। রাজ অ্যান্ড ডিকে-র আর এক সৃষ্টি, প্রাইমেরই আর এক জনপ্রিয় সিরিজ ‘পাতাল লোক ২’-তে উত্তর-পূর্ব ভারত জুড়ে জয়দীপেরই দাপুটে কীর্তিকলাপ মনে পড়ে যায় বার কয়েক। তা ছাড়া, ক্লাইম্যাক্সও যে শেষ হইয়াও হইল না শেষ! যদিও সব পেরিয়েই স্বমহিমায় বিরাজ করে ‘ফ্যামিলি ম্যান’, সমান দাপটে। সেটা অনস্বীকার্য। এবং সেখান থেকেই শুরু চতুর্থ সিজনের অপেক্ষা।

 


শেষমেশ থেকে যায় একটা ছোট্ট প্রশ্ন। সিজন ২-এর শেষে ইঙ্গিত ছিল পরের সিজনে কাহিনি গড়াবে কলকাতায়। তার কি হল?