ভারতীয় চলচ্চিত্রের যুগনায়ক ধর্মেন্দ্র। ছ’দশকের রাজত্বে তিনশোরও বেশি ছবি অভিনেতার। পাঞ্জাবের মানসপুত্রের প্রয়াণে শেষ হল এক সোনালি যুগ।
কিংবদন্তি তারকার জন্ম ১৯৩৫ সালের ৮ ডিসেম্বর, পাঞ্জাবের লুধিয়ানা জেলার নসরালি গ্রামে। এক সাধারণ পরিবারের ছেলে থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কোটি মানুষের হৃদয়ের নায়ক। ছোটবেলা থেকেই সিনেমার প্রতি ছিল গভীর ভালবাসা। কলেজে পড়াকালীনজয় করেন ফিল্মফেয়ার ট্যালেন্ট হান্ট, আর সেই জয়ই তাঁকে নিয়ে আসে মুম্বই— শুরু হয় সাফল্যের যাত্রা।
১৯৬০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দিল ভি তেরা হম ভি তেরে’ -র মাধ্যমে বড়পর্দায় আত্মপ্রকাশ করেন ধর্মেন্দ্র। তারপর একে একে ‘ফুল অউর পাত্থর, ‘অনুপমা’, ‘বন্দিনী’, ‘আয়ে দিন বাহার কে’, ‘সীতা অউর গীতা’, ‘ইয়াদোঁ কি বারাত’, ‘চুপকে চুপকে’, ‘শোলে’, ‘দোস্ত’, ‘জুগনু’— একের পর এক ছবিতে তিনি যেন নিজের প্রাণ ঢেলে দিয়েছেন।
ধর্মেন্দ্রর সুদর্শন চেহারাই যেন তাঁকে কয়েক যোজন এগিয়ে রেখেছিল তাঁর সমসাময়িকদের থেকে। বিশেষ করে ‘শোলে ’ ছবির বীরু চরিত্র তাঁকে অমর করে রেখেছে ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। নায়কের অনায়াস হাসি থেকে প্রেমাতুর চাউনি আর নায়কোচিত সংলাপ— তাঁকে গোটা এক প্রজন্মের কাছে ‘হিরো’ করে তোলে।
অ্যাকশন হিরো হিসেবে ধর্মেন্দ্র ছিলেনও তুলনাহীন। কিন্তু রোমান্টিক চরিত্রেও তাঁর অভিনয় দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়েছিল। ‘চুপকে চুপকে’ বা ‘গুড্ডি’র মতো ছবিতে শুধু নায়ক থেকে অভিনেতা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন অবলীলায়।
তবে শুধু পর্দায় নয়, বাস্তব জীবনেও তিনি বেঁচে ছিলেন নায়কের মতোই। সাধারণ মানুষের কথা, কৃষকের দুঃখ— সবই ছিল ছুঁয়ে যেত তাঁর অন্তর। ২০০৪ সালে তিনি ভারতীয় জনতা পার্টির হয়ে রাজস্থানের বিকানের থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতি, খ্যাতি, সাফল্য— কোনও কিছুই তাঁর বিনয়ী স্বভাবকে বদলাতে পারেনি।
ছবির মতোই ধর্মেন্দ্র ব্যক্তিগত জীবনেও ছিল ঘটনার ঘনঘটা। ১৯৫৪ সালে স্ত্রী প্রকাশ কউরের সঙ্গে প্রথমে সংসার সাজিয়েছিলেন নায়ক। তাঁদের দুই পুত্র— সানি দেওল এবং ববি দেওল, বাবার মতোই বলিউডে নিজের জায়গা তৈরি করেছেন। কিন্তু সেই সংসারেও চিড় ধরে এক সময়। পরবর্তীতে বলিউডের ‘ড্রিম গার্ল’, বয়সে ১২ বছরের হেমা মালিনীর প্রেমে পড়েন নায়ক। ধর্ম পরিবর্তন করে ১৯৮০ সালে তাঁর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দুই কন্যা— এষা দেওল এবং অহানা দেওল। হাজারও বিতর্ক পেরিয়ে দুই স্ত্রীর প্রতি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন অভিনেতা। সমালোচনা-কটাক্ষকে তুড়িতে উড়িয়েছেন।
ছয় থেকে নয়ের দশক পর্যন্ত ধর্মেন্দ্র জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। কর্মজীবনের শুরুর দিকে তাঁকে বিশ্বের অন্যতম সুদর্শন পুরুষ হিসেবে বিবেচনা করা হত। এবং তিনি বলিউডে পরিচিত ছিলেন ‘হি-ম্যান’ নামে। আদ্যোপান্ত ‘মশালাদার’ বাণিজ্যিক ছবিকে তিনি এমন সহজাত দক্ষতায় সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন যে, মানুষ তাঁর অভিনয়ে খুঁজে পেত নিজেদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। শহর হোক বা গ্রাম, ধনী হোক বা সাধারণ মানুষ— ধর্মেন্দ্র ছিলেন সকলের আপনজন। সেই সময় রিকশার পিছনের পোস্টার থেকে শুরু করে অষ্টাদশীর বইয়ের পাতার ফাঁকেও জায়গা ছিল তাঁরই ছবির। যেন ধর্মেন্দ্র শুধু পর্দার নায়ক নন, সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এক আবেগ, এক মুগ্ধতা।
দীর্ঘ অভিনয় জীবনে লক্ষ লক্ষ মানুষের মন যেমন জয় করেছেন, তেমনই পুরস্কার পেয়েছেন অগণিত। ১৯৯১ সালে ‘ঘায়েল’-এর সুবাদে আসে জাতীয় পুরস্কার। ২০২১ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান ভারতীয় চলচ্চিত্রে তাঁর অবদানের জন্য। ২০১২ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মানে সম্মানিত করে।
নব্বইয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে ধর্মেন্দ্র শরীর নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও ভক্তরা তাঁর মনের সজীবতায় মুগ্ধ ছিলেন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নায়ক থেকে পরিণত হয়েছেন চরিত্রাভিনেতায়— আর সেখানেও নিজস্ব ছাপ রেখে গিয়েছেন অচিরে। প্রতিটি চরিত্রেই তিনি যেন নতুন করে জন্ম নিয়েছেন, প্রমাণ করেছেন— সত্যিকারের শিল্পীর বয়স হয় না, শুধু রূপ বদলায়। ‘প্যায়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’, ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’, ‘আপনে’, ‘রকি অউর রানি কি প্রেম কহানি’-র মতো ছবিগুলি তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
প্রকৃতির নিয়মে এক যুগের অবসান হল আজ। তবু থেকে আগামীর জন্য রয়ে গেল মৃত্যঞ্জয়ী আলো। ধর্মেন্দ্র অমর হয়ে থাকলেন। স্মৃতিতে, শিল্পে।
