প্রেম, অতীত, পাওয়া, না-পাওয়া আর পিছুটান, অমলিন আবেগের বিনিসুতোয় বাঁধা ফিরোজ আর সমীরার সম্পর্কের সুর। যা কিছু পুরনো, ফেলে আসা, তা সবই যেন চলে গিয়েও থেকে যাওয়া ভালবাসার দলিল। প্রশ্ন জাগতে পারে, ফিরোজ-সমীরা কে? কী তাদের পরিচয়? উত্তর লেখা আছে রূপসা গুহ পরিচালিত ছবিতে। নাম ‘হাউ আর ইউ ফিরোজ’।
সেই ছবিরই অন্যতম দুই প্রধান চরিত্র ফিরোজ এবং সমীরা। পর্দায় তাদের জীবন্ত করে তুলেছেন আরিয়ান ভৌমিক এবং রাতাশ্রী দত্ত। বর্তমানে টলিউডে বাণিজ্যিক ছবির রমরমার মাঝেই নিশ্চুপে নিজের কাজ করে গিয়েছে ‘হাউ আর ইউ ফিরোজ’। বক্স অফিসের হিসেবনিকেশের ঊর্ধ্বে গিয়ে দর্শকমহলে প্রশংসিত স্বল্প বাজেটে তৈরি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবিটি। আর তাতেই আশার আলো দেখছেন আরিয়ান। তাঁর কথায়, “আমি খুব নিশ্চিত ছিলাম ছবিটি দর্শকের পছন্দ হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছবি তৈরির ক্ষেত্রে আমরা প্রশ্ন করি, ‘দর্শকের ভাল লাগবে কি?’ তার পর সেই মতো আমরা গল্প তৈরি করি। সেই বুঝে কাজ করি। খুব কম ক্ষেত্রেই এরকম হয় যে, পরিচালক শুধুমাত্র নিজের গল্প বলার জন্য ছবি করেছেন। আমরা সকলেই দেখেছি রূপসাদি কী কষ্ট করে এই ছবিটি তৈরি করেছেন। যে গল্পটা তিনি বলতে চেয়েছিলেন, সেটাকেই পর্দায় তুলে ধরেছিলেন। শুরু থেকেই ওঁর এই সততার প্রতি আমার ভরসা ছিল। আর এখন যখন দেখছি দর্শকের ছবিটি এত ভাল লেগেছে, তখন অভিনেতা হিসাবে আরও সাহস পাচ্ছি।”
আরিয়ানের মতো রাতাশ্রীও মনে করেন, এই ছবির মূলধন হল তার সহজ অথচ ভাবিয়ে তোলা গল্প। ‘ব্লকবাস্টার’ তকমা পাওয়ার ইঁদুরদৌড়ে শামিল না হয়ে তাই ভরসা রেখেছিলেন ‘অন্য ধারা’র ছবিতে। তাঁর কথায়, “এই ছবিটার গল্পে অন্য রকম একটা ভালবাসার জায়গা আছে। দর্শক হিসাবে যেটা আমায় টেনেছিল। তাই মনে হয়েছিল, আমার মতো বাকিদেরও এই ছবি ভাল লাগবে। আরিয়ান আমার অন্যতম সেরা সহ-অভিনেতাদের মধ্যে একজন। যে ইতিবাচকতা নিয়ে আমরা কাজটা করেছিলাম, আশা ছিল, মানুষ একটু হলেও তার আঁচ পর্দায় পাবেন। কিন্তু ছবিটা মুক্তির পর যে সাড়া পেয়েছি, তা আমার কাছে একেবারেই উপরি পাওনা।”
ভাষা-ভূগোলের গণ্ডিতে ‘হাউ আর ইউ ফিরোজ’কে বাঁধতে চাননি রূপসা। তিনি চেয়েছিলেন, এই ছবির হাত ভালবাসার রেশ ছড়িয়ে পড়ুক গোটা বিশ্বে। তাঁর ছবির প্রোটাগনিস্ট থুড়ি নায়ক এক পারসি যুবক। আরিয়ানের কাঁধে ছিল তার প্রাণপ্রতিষ্ঠার দায়িত্ব। প্রায় পুরো নম্বর পেয়েই পাশ করে গিয়েছেন টলিউডের তরুণ নায়ক। কেমন ছিল প্রস্তুতি? তাঁর কথায়, “পারসি চরিত্রে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা আমার কাছে একেবারেই নতুন। এই কালচার নিয়ে আমি আগে প্রচুর বই পড়েছি। তখন থেকেই খুব ইন্টারেস্টিং লাগত বিষয়টা। মনে মনে চেয়েছিলাম, কোনও দিন এরকম কোনও একটা চরিত্র করব, সেই আশায় পূর্ণ হল।” তিনি মনে করেন, শুধু ভাল গল্পই নয়, এই ছবি দর্শককে উপহার দিয়েছে এক অব্যক্ত ভাললাগাও। আর তা-ই হয়ে উঠেছে ‘হাউ আর ইউ ফিরোজ?’-এর অন্যতম শক্তি।
রাতাশ্রীর কথায়, পারসি সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর বিস্তর জ্ঞান নেই। সেই বিষয়ে তাঁকে অনেকটাই সাহায্য করেছেন সহকর্মী আরিয়ান। তবে অন্য একটি সংস্কৃতির রেশ পর্দায় নিয়ে আসাই কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল না। রাতাশ্রীর কথায়, “একটা পিরিয়ডিক চরিত্র করেছি। সেই সময়ের সহজভাবটা নিয়ে আসাই ছিল আসল চ্যালেঞ্জ। আসলে আমরা সময়ের সঙ্গে এতটাই বদলে গিয়েছি যে আমাদের মধ্যে আর সারল্যটাই নেই। তাই সেটা ফুটিয়ে তুলতে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে।”
‘হাউ আর ইউ ফিরোজ’-এর অনেকটা জুড়ে রয়েছে পুরনোকে ঘিরে নস্টালজিয়া। যাতে সময়ের ধুলো পড়ে না। বছর বাড়লে আবছা হয় না যে স্মৃতি, তাকে ঘিরেই যেন বেঁধে দেওয়া চরিত্রদের সুর। পর্দার নায়ক-নায়িকা বাস্তবেও এমন? আগলে রাখেন অতীতকে? নাকি ‘যা গেছে তা যাক’-এ বিশ্বাসী? দু’জনের সম্মিলিত উত্তর, “যাদের সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক, সুন্দর সময়ের স্মৃতি আছে, তাদের জিনিসগুলো আগলে রাখি।” তাই আজও আরিয়ানের কাছে রয়ে গিয়েছে প্রথম শর্ট ফিল্মে ব্যবহার করা ক্যামেরা, ঠাকুরমার প্রিয় বাক্স। রাতাশ্রীও পরম যত্নে আগলে রাখেন ফেলে আসা দিনের স্মৃতি। কোনও কিছুই সহজে ফেলে দিতে পারেন না। সেই ‘উপদ্রব’-এ ঘরে জায়গা না থাকায় মায়ের কাছে বকুনিও শোনেন বটে! তবু পাল্টায় না তাঁর হৃদয়-দফতর।
এক সময় চলেছে অগুনতি চিঠি লেখালেখির পালাও। আরিয়ান চিঠি লিখেছেন বইয়ে পড়া, ছবিতে দেখা তাঁর প্রিয় চরিত্রদের। বাবার উদ্দেশ্যে পাতার পর পাতা শব্দে ভরিয়েছেন রাতাশ্রী। দু’জনেই মনে করেন, সাদা পাতায় মনের ভাব ব্যক্ত করে যে আরাম, তা হোয়াটসঅ্যাপ, ইমেলে মেলে না। মিলবে না। খানিক আনমনে রাতাশ্রী বললেন, “অনেক মানুষ চলে যায়। কিন্তু সম্পর্কগুলো থেকে যায়। ঠিকানাগুলো থেকে যায়। চিঠি পাঠানো হয় না আর।” দিনশেষে পর্দার নায়ক-নায়িকার জীবনও যে আদৌ ছবির মতোই, তা মেনে নিতে দ্বিধা নেই তাঁদের।
টলিপাড়ার বিদ্বজনেরা মনে করছেন, ‘হাউ আর ইউ ফিরোজ’ সাফল্যের যাত্রাপথে অনেকটাই এগিয়ে দেবে আরিয়ান এবং রাতাশ্রীকে। কিন্তু বর্তমানে শুধুই কি অভিনয়ের জোরে কাজ পাওয়া যায়? নাকি সোশ্যাল মিডিয়ার ‘ফলোয়ার’ আর ‘লাইক’-এর নিক্তিতেও মেপে দেখা হয় প্রতিভা? আরিয়ানের সহজ উত্তর, “কোনও কিছুর যখন চল শুরু হয়, সেটা নিয়ে মাতামাতি হয়। আমি ব্যক্তিগত ভাবে সোশ্যাল মিডিয়া সেভাবে ব্যবহার করি না। কিন্তু কোনও ইনফ্লুয়েন্সার যদি ফলোয়ারের জোরে কাজ পেয়ে ভাল অভিনয় করেন, তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু অনেক সময়ই তেমনটা হয় না। এমন উদাহরণও আছে। বরং অনেক প্রতিভাবান শিল্পী বঞ্চিত থেকে যান। রিল বানানো আর অভিনয় করার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। একদিন আবার সেটা সকলে বুঝবেন।”
রাতাশ্রীও কাজ ছাড়া আলোকবৃত্তের চোখ ধাঁধানো ঝলকানি থেকে দূরে রাখেন নিজেকে। প্রতিভার জোরেই ভাল কাজ পাবেন বলে তাঁর বিশ্বাস। অভিনেত্রীর কথায়, “আমি সোশ্যাল মিডিয়াটা বিশেষ করতে পারি না। আমার অভিনয়ের জন্য যদি কেউ নিতে চান, অবশ্যই নেবেন। কিন্তু কেউ যদি সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য কাজ পান, তাতে আমার আপত্তি থাকবে না। কারণ তিনি হয়তো সেই জায়গায় আমার থেকে বেশি এগিয়ে।”
‘হাউ আর ইউ ফিরোজ’-এর হাত ধরে আপাতত প্রশংসায় ভাসছেন আরিয়ান এবং রাতাশ্রী। ছবির নায়কের কথায়, “অনেকেই বলছেন, প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে এই ছবির রেশ তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন। একজন আমার পারফর্ম্যান্সকে ‘কুইন্টেসেনশিয়াল’ বলেছেন। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া।” নায়িকা বললেন, “যাঁরা ছবিটি দেখেছেন, তাঁরা বলেছেন, পর্দায় রাতাশ্রীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। একজন অভিনেত্রীর কাছে এর থেকে বড় প্রাপ্তি কী-ই বা হতে পারে।”
