বিভাস ভট্টাচার্য
ইতিহাস গড়লেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের শিশুরোগ বিভাগের চিকিৎসকরা। বিরল মৃগীরোগে আক্রান্ত ছ'মাস বয়সী একটি শিশুর রোগ শনাক্ত করে তাকে স্থিতিশীল করে তুললেন তাঁরা। চিকিৎসকদের কথায়, এই রোগটি বিরল এবং জটিল এক জেনেটিক রোগ। এমন একটি মৃগীরোগ যা বিশ্বে হাতে গোনা কয়েকজন শিশুর শরীরে ধরা পড়েছে। হাসপাতালের তরফে জানানো হয়েছে দেশের মধ্যে এই শিশুটি হল সর্বকনিষ্ঠ রোগী। যার মধ্যে এই বিরল মৃগীরোগের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের অধ্যক্ষ ডাঃ ইন্দ্রনীল বিশ্বাস বলেন, 'এই বিরল এবং জটিল রোগটির মুখোমুখি হওয়ার পর এখানকার চিকিৎসকরা একদিকে যেমন বিজ্ঞানের আশ্রয় নিয়েছিলেন তেমনি তাঁদের মধ্যে ছিল সহৃদয়তা ও নিষ্ঠা। সব মিলিয়ে তাঁরা যা করে দেখালেন সেটা ভবিষ্যৎ চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে একটা উদাহরণ হয়ে থাকল।'
এবিষয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের শিশুরোগ বিভাগের অধ্যাপক চিকিৎসক দিব্যেন্দু রায়চৌধুরী বলেন, 'যে শিশুটি এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে সে একটি কন্যাসন্তান। রোগের শুরুটা হয়েছিল সাধারণ জ্বর ও খিঁচুনি দিয়ে। কিছুদিন চিকিৎসা হওয়ার পর বোঝা গেল রোগটা সাধারণ নয়। পরপর খিঁচুনির সঙ্গে শিশুটি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে তার শারীরিক অবনতি ঘটতে থাকে। এরপর তার পরিবারের তরফে নিয়ে আসা হয় এই হাসপাতালে। পরীক্ষা করেই বোঝা যায় শিশুটি কোনো সাধারণ রোগে ভুগছে না। জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত এবং সেটা শনাক্ত করাটা একটা চ্যালেঞ্জ। শুরু হল লড়াই।'
প্রাথমিকভাবে চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে দেখেন শিশুটির শরীরে কোনও সংক্রমণ আছে কিনা। এরপর মস্তিষ্কে প্রদাহ বা জন্মের সময় শিশুটি কোনোরকম আঘাত পেয়েছিল কিনা সেই বিষয়েও খোঁজ নেন। কিন্তু দেখা যায় সেরকম কিছু নেই। অথচ শিশুটির খিঁচুনি কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছিল না এবং সে দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছিল। চিকিৎসরা সিদ্ধান্ত নেন শিশুটির ব্রেইন বা মস্তিষ্কের 'এমআরআই স্ক্যান' করার।
পরীক্ষায় শিশুটির মস্তিষ্কে তাঁরা বেশ কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেন। যা দেখার পরেও তাঁরা নিশ্চিত হতে পারছিলেন না শিশুটির আসল সমস্যাটা কী? এরপর তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন জেনেটিক পরীক্ষা করার। সেখানেই ধরা পড়ে শিশুটির একটি বিরল জিনগত পরিবর্তন হয়েছে। অধ্যাপক চিকিৎসক দিব্যেন্দু রায়চৌধুরী জানান, 'শিশুটির SEMA6B নামক জিনে একটি মিউটেশন হয়ে গিয়েছে। এই জিনটির সঙ্গে একধরনের বিরল 'প্রগ্রেসিভ মায়োক্লনিক এপিলেপ্সি' বা পিএমই রোগের সম্পর্ক গত ২০১৯-২০২১ সালে বিশ্বে প্রথম শনাক্ত হয়। গোটা বিশ্বে মাত্র কয়েকজন শিশুর এখনও পর্যন্ত এই রোগ ধরা পড়েছে।'
রোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পিএমই রোগে আক্রান্ত শিশুরা প্রথমাবস্থায় স্বাভাবিকই থাকে। আলাদা করে কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। সঙ্গে যোগ হয় ঘন ঘন ঝাঁকুনির মতো খিঁচুনি। হাঁটাচলার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয় এবং এদের শেখার ক্ষমতা বা বুদ্ধিবৃত্তিও সেভাবে বাড়ে না। সবচেয়ে বড় বিষয় হল এখনও পর্যন্ত এই রোগের পুরোপুরি কোনো চিকিৎসাও নেই।
হাল না ছেড়ে চিকিৎসা চালিয়ে যান চিকিৎসকরা। শেষপর্যন্ত সাড়া মেলে তাঁদের চিকিৎসায়। অবস্থার অবনতি হওয়ার জন্য শিশুটির জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের। চিকিৎসার গুনে সে সুস্থ হয়ে উঠলে তাকে এবার সেখান থেকে বের করে আনা হয়। ফিডিং টিউবের মাধ্যমে তাকে খাওয়ানো হয়। স্থিতিশীল হওয়ার পর গত সপ্তাহেই তাকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছেন তার অভিভাবকরা।
এই প্রসঙ্গে ডাঃ সৌরভ নন্দী বলেন, এত ছোট বয়সে এরকম একটা রোগ চিহ্নিত করে রোগীকে সফলভাবে স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনা চিকিৎসাক্ষেত্রে এক বিরাট মাইলফলক।
এবিষয়ে শিশুরোগ বিভাগের আরও এক চিকিৎসক ডাঃ গার্গী গায়েন বলেন, 'বিশ্বে মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন শিশুর শরীরে এই রোগ ধরা পড়েছে। এত অল্প বয়সে তার রোগ শনাক্ত এবং স্থিতিশীল করে বাড়ি ফেরাতে পারাটা আমাদের কাছে শুধু পেশাগত গর্ব নয়, এটা একটা মানবিক বিজয়।' যদিও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, যেহেতু এই রোগের সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয় সেজন্য শিশুটিকে সারাজীবন ওষুধ খেয়ে যেতে হবে এবং তার বুদ্ধি বিকাশের জন্য প্রয়োজন হবে সহায়তার।
