RD | ২৪ জুন ২০২৫ ১৩ : ১৮Rajit Das

আজকাল ওয়েবডেস্ক: ১২ দিনের সংঘাতের বিরতি। ইরান ও ইজরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে। আমেরিকা অপারেশন মিডনাইট হ্যামারে যোগ দিতেই মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছিল। তবে আপাতত স্বস্তিতে বিশ্ব।  

গত ১২ ঘন্টায় ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ নায়কীয় মোড় নেয়। গত সপ্তাহে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন বলেছিল যে, তারা দুই সপ্তাহের মধ্যে এই সংঘাতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু তার দুই দিন পরেই, মার্কিন বি-২ বোমারু বিমান ইরানের তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্রে আঘাত হানে, যা ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে বড় ধরনের উত্তেজনার আশঙ্কা তৈরি করে। গত রাতে, ইরান কাতারে মার্কিন আল উদেইদ বিমান ঘাঁটিতে বোমা হামলা চালায়, ফলে আঞ্চলিক সংঘাত বিশ্বব্যাপী সংকটে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। তারপরই নাটকীয়ভাবে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে, তেল আবিব এবং তেহরান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।

মজার ব্যাপার হলো, যুদ্ধবিরতির পর থেকেই তিন দেশ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইরান এবং ইজরায়েল) তাদের সাফল্যের দাবি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করতে পারে যে, এতে ইরানের পারমাণবিক ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ইজরায়েল, তেহরানের দুর্বলতা দুনিয়ার সামনে তুলে ঝরতে পারে। বাকি রইল ইরান। তেহরান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এবং পিছপা না হওয়ার জন্য গর্ব করতে পারে। আধুনিক যুদ্ধের একটি মূল দিক হল অভ্যন্তরীণ বার্তাপ্রেরণ। এছাড়া তিনটি দেশেরই প্রচারযন্ত্র এখন জনগণকে তাদের জয়ের বিষয়টি বোঝানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাভ:

দীর্ঘদিন ধরে সংঘাতের কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে অবস্থান নেওয়া আমেরিকা রবিবার ইরানে তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্রে চালানোর পর তার বি-২ বোমারু বিমানের অবস্থান পরিবর্তন করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে "মধ্যপ্রাচ্যের দাঙ্গাবাজ" বলে অভিহিত করেন। সতর্ক করে দেন যে তেহরান যদি "শান্তি স্থাপন না করে", তাহলে পরবর্তী আক্রমণগুলি "অনেক ভয়ঙ্কর এবং অনেক হবে।" রবিবারের হামলার পর, ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলি "সম্পূর্ণ এবং সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস" হয়ে গিয়েছে। যদিও শীর্ষ মার্কিন কর্তাদের দাবি, প্রাথমিক মূল্যায়নে দেখা গিয়েছে যে, পারমাণবিক কেন্দ্রগুলির "গুরুতর ক্ষতি" হয়েছে।

তবে ওয়াশিংটন জানত যে, সংঘাত অনন্তকাল ধরে চলতে পারে না। ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনা বাদ দিলে, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকারক হবে। কারণ তিনি প্রায়শই তার পূর্বসূরীদের "যুদ্ধে চিরকালীন" পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মুখর ছিলেন। ট্রাম্প জানতেন যে, জনপ্রিয় অভ্যন্তরীণ সমর্থন না হারিয়ে উত্তেজনার পথ থেকে সরে আসার জন্য তেহরানের একটি পিছু হঠার পথ প্রয়োজন। অতএব, কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের হামলার পর পরই হুঁশিয়ারি দিয়ে ট্রাম্প পাল্টা আক্রমণ না করার সিদ্ধান্ত নেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট করেন, যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করেন। 

এই সংঘাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনও সেনা বা আধিকারিকের ক্ষতি হয়নি। এদিকে মার্কিন বাহিনী প্রচুর শক্তি প্রদর্শন করেছে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় ওয়াশিংটন বলতেই পারে এই পরিস্থিতি তাদের কাছে 'Win Win Situation'।

ইজরায়েলের গর্ব:

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার আগের সপ্তাহে, ইজরায়েল তেহরানের পারমাণবিক ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে। ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে তুচ্ছ করে নিজেদের বিমান শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় ইজরায়েল। ইসরায়েলি বাহিনী ইরানের ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদেরও হত্যা করে, যার মধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী শাদমানিও ছিলেন। তাদের বিমান হামলায় তেহরানের গোয়েন্দা প্রধান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ কাজেমি এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মোহাকে নিহত হন। বিমান হামলার ফলে সৃষ্ট ইরানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ইজরায়েলকে যুদ্ধে সহায়তা করে, একটি দৃঢ় লড়াকু বাহিনী হিসেবে তাদের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করে।

ইজরায়েলের বড় লাভ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে যোগদান। দীর্ঘদিন ধরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতকে ইরান বনাম ইজরায়েল হিসাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিল এবং যোগ দিতে অনিচ্ছুক ছিল। অপারেশন মিডনাইট হ্যামারের মাত্র নয় দিন আগে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছিলেন যে, ইরানের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের পদক্ষেপ "একতরফা" এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র "জড়িত নয়"। কিন্তু আগামী দিনে, ট্রাম্প মার্কিন অবস্থান পরিবর্তন করে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা আলী খামেইনিকে হুমকি দেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলকে একটি ইউনিট হিসেবে উল্লেখ করেন।

ইরানে মার্কিন বিমান হামলা কেবল তেহরানের কাছেই নয়, বরং বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করেছে যে- ওয়াশিংটন তেল আবিবের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক ভাবমূর্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি, এই সংঘাত ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর জন্যও উপকারী হবে। কারণ ইজরায়েলে আগামী বছর নির্বাচন হওয়ার কতা রয়েছে। 

ইরানের 'প্রতিরোধ':

ইরানে মার্কিন বিমান হামলা তেহরানকে একটি জটিল পরিস্থিতিতে ফেলেছিল। তাদের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তাদের প্রতিপক্ষ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। তাদের মুখ রক্ষা করার পাশাপাশি প্রস্থান পথ নিশ্চিত করার প্রয়োজন ছিল। প্রতিবেদন অনুসারে, আয়াতুল্লা একটি বাঙ্কারের ভেতর থেকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে- ইরানকে পাল্টা আক্রমণ করতে হবে, কিন্তু সংঘাত যাতে আরও না ছড়িয়ে পড়ে সেজন্য সংযতভাবে করার নির্দেশ ছিল। কাতারের আল উদেইদ বিমান ঘাঁটি বেছে নেওয়া হয়েছিল। এই অঞ্চলেই রয়েছে বৃহত্তম মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। ইরানি কর্তারা মনে করেছিলেন য়ে, এটি অপারেশন মিডনাইট হ্যামার পাল্টা হিসাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাতার ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় কাজটি আরও সহজ হয়েছিল।

মজার বিষয় হল, ইরান মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার কয়েক ঘন্টা আগে একটি আগাম নোটিশ পাঠিয়েছিল। এই বার্তা কাতারকে তার আকাশসীমা বন্ধ করতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্যবস্তু এলাকা পরিষ্কার করতে প্ররোচিত করেছিল। সেই প্রেক্ষিতে ট্রাম্প তেহরানের প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে লিখেছিলেন, "ইরান তাদের পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংসের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে খুব দুর্বল প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, যা আমরা আশা করেছিলাম এবং খুব কার্যকরভাবে প্রতিহত করেছি।"

হামলার আগে ইরানের সতর্কীকরণ স্পষ্টতই ইঙ্গিত দেয় যে, তেহরান শক্তি প্রদর্শন করতে চাইলেও আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার কোনও ইচ্ছে তাদের ছিল না। ইরান জানত যে, যদি আমেরিকানরা তাদের আক্রমণে মারা যায়, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জবাব দিতে উৎসাহিত করা হবে। কিন্তু, সতর্কীকরণ এবং কোনও হতাহত না হওয়ার ঘটনা নিশ্চিত করে যে ট্রাম্পকে আর প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে না। ইরানও আগ্রাসনে কিছুটা বিরত হয়। তবে, যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট আগে পর্যন্ত তেহরান ইজরায়েলের উপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে থাকে। কিন্তু তাতে কেউ মারা যায়নি, এবং ইরান তার প্রস্থান পথ পোক্ত করে। একই সঙ্গে, তেহরান প্রমাণ করতে পারে যে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তাদের রয়েছে। এতে বিশ্বে তাদের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হয়। 

আদতে সব ঠিক আছে? 

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিরতি স্বাগত। যারা এই অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক পরিণতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল সেইসব বিশ্বশক্তিগুলিকে স্বস্তি দিয়েছে এই পরিণতি। কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপ মোটেই পোক্ত নয় বলে মনে করা হচ্ছে। আমেরিকা দাবি করেছে যে, ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে, তেহরান তা অস্বীকার করেছে। এই সংঘাত তেহরানের পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধিকে ইন্ধন যুগিয়েছে। পাশ্চাত্য শক্তিগুলি স্বীকার করেছে যে, তারা নিশ্চিত নয় যে ইরানের ইউরেনিয়াম মজুদের কী হয়েছে। তাই যুদ্ধবিরতি স্বস্তি হলেও অনেক প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে। গোটা বিশ্ব আশা করে যে, বিবদমান দেশগুলি আলোচনার মাধ্যমে কূটনীতির মাধ্যমে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে।