আজকাল ওয়েবডেস্ক: তাঁর নাম সাহিল হরিজন। তাঁকে 'ভাইরাল সাহিল' বললেও বোধহয় অত্যুক্তি করা হবে না। শনিবার কলকাতা লিগে ইউনাইটেড স্পোর্টসের এই তরুণ ফুটবলার চারজনকে মাটি ধরিয়ে যে গোল করেছেন, তা ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। সেই গোল নিয়েই চর্চা হচ্ছে খুব। 

আজকাল ডট ইন-কে হাবড়া নিবাসী সাহিল বললেন, ''এরকম গোল আমি আগেও করেছি। গত বছর চোটের জন্য খেলতে পারিনি। তার আগের বছর পাঠচক্রের হয়ে বাইসাইকেল কিকে একটা গোল করেছিলাম। সেই গোলটাও ভাইরাল হয়েছিল।'' শনিবার এরিয়ানের চক্রব্যূহ ভেদ করে বাঁ পায়ের বাঁক খাওয়ানো শটে গোল করেন তিনি। 

এরকম দৃষ্টিনন্দন গোল দেখার জন্যই হাজার মাইল পথ হাঁটা যায়। ১৯ বছরের সাহিল হরিজনের ফুটবলে রয়েছে এমন এক আকর্ষণ, যার টানে ছুটে আসা যায় দূরদূরান্ত থেকে। শুধু তাঁকেই দেখার জন্য এবার থেকে সবুজ গালচেতে নামুক ভিড়ের ঢল। ভার্চুয়াল জগতে তাঁর স্কিলের বিচ্ছুরণ না দেখে মাঠে বসে তরুণ ফুটবলারের প্রতিভা প্রত্যক্ষ করুক বাংলার ফুটবল পাগলরা। সাহিলের মতো খেলোয়াড়দের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব যে সবার। 

এরিয়ানের বিরুদ্ধে মাঝমাঠে বলটা ধরার পরই কি গোলের গন্ধ পেতে শুরু করেছিলেন? গোলের মতোই সুন্দর সাহিলের বক্তব্য, ''কারওর পক্ষেই ওভাবে বলা কি সম্ভব? পরিস্থিতির উপরে সব নির্ভর করে। বল পায়ে পড়ার পরে মনে হয়েছিল আমি দু'জন-তিন জনকে ড্রিবল করে গোল করতে পারব। সেই আত্মবিশ্বাস আমি দেখাতে পেরেছি।'' 

অনুশীলন, অনুশীলন আর অনুশীলন তাঁকে করে তুলেছে আত্মবিশ্বাসী। সেই কারণেই মাঠে নেমে তিনি ছড়িয়ে দিতে পারছেন রামধনুর মতো রং। সেই রংয়ে রঙিন কলকাতার মাঠ। 

 

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে ভালবেসে সাত নম্বর জার্সি পরেন। পুরোদস্তুর স্ট্রাইকার বলতে যা বোঝায় তিনি তাই-ই। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার, উইঙ্গার হিসেবেও খেলতে দক্ষ। প্রতিটি ম্যাচে গোল করাই তাঁর নতুন টার্গেট। সাহিল বলছিলেন, ''দ্বিতীয় ডিভিশন আই লিগে আমি সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলাম। ১১টা গোল করেছিলাম। তার পরে চোট পেয়ে গেলাম। চোট সারিয়ে ফিরে এসে ৬-৭টা গোলও করেছি। এবারের কলকাতা লিগে প্রতিটি ম্যাচের স্কোরলাইনে নিজের নাম দেখতে চাই।'' 

ফুটবলের পাশাপাশি বাংলায় অনার্স পড়ছেন সাহিল। উচ্চমাধ্যমিকে আশি শতাংশ নম্বর পেয়েছেন। একসঙ্গে পড়া-খেলা চালানো সম্ভব? উনিশের কিশোরের সাফ জবাব, ''ইচ্ছা থাকলে সবই সম্ভব।'' ইচ্ছাশক্তিতে ভরপুর এই কিশোর। চোট আঘাতের লাল চোখ দেখে প্রায় মাস ছয়েক ছিটকে যেতে হয়েছিল। চোট সারিয়ে ফিরে এসে তিনি আবার ছুটছেন। আবার গোল করছেন। তাঁর মায়ের মুখে খেলা করছে হাসি। সারা দিনের পরিশ্রমের শেষে বাবাকেও স্বস্তি এনে দিচ্ছে সাহিলের ফুটবল। তিনি বলছিলেন, ''চোট পাওয়ার দিনগুলোতে মা-বাবা-আমার চাওয়া একই ছিল। চোট সারিয়ে ফিরে আসতে হবে।'' সবার ইচ্ছা-চাওয়া যখন এক বিন্দুতে এসে মিলে যায়, তখন পৃথিবীর কোনও শক্তি পারে না রুখতে। 

বাবা হাবড়া পৌরভার অ্যাম্বুল্যান্স ড্রাইভার। মা গৃহবধু।  বাড়ির পাশের মাঠে বাবার হাত ধরেই প্রথম ফুটবলে পা রাখা। তার পরে অশোকনগরের পল স্যরের কাছ থেকে ফুটবলের প্রাথমিক পাঠ নিয়ে এটিকে-তে ট্রায়াল দেওয়া। সেখানে তিন বছর কাটিয়ে নতুন ঠিকানা ইউনাইটেড স্পোর্টস। জহুরি জহর চেনেন। নবাব ভট্টাচার্যও চিনতে ভুল করেননি সাহিলকে। ইউনাইটেড স্পোর্টসের জার্সিতেই চলছে তাঁর ফুটবল পরিক্রমা। সাহিল বলছেন, ''আমাদের ইউনাইটেড স্পোর্টস একটা পরিবারের মতো। নবাব কাকুর পরামর্শ সব সময়ে রয়েছে। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল সেটাই আমাদের দেখিয়ে দেন উনি।'' কোচ লালকমল ভৌমিক তাঁর ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড। জমে উঠেছে গুরু-শিষ্যের রসায়ন। 

কথায় বলে সাফল্যের আলোয় ধাঁধিয়ে যায় চোখ। ব্যর্থতা-ভুল চোখে পড়ে না। সাহিল বলছেন, ''ভাল গোল যেমন আনন্দ দেয়। তেমনই ম্যাচে কী ভুল করলাম, সেটা ভাবাও জরুরি। এরিয়ানের বিরুদ্ধে আমাকে পেনাল্টি বক্সের ভিতরে মেরেছিল। আমি কাট করে ভিতরে ঢুকে পড়েছিলাম। পেনাল্টি দিলেও দিতে পারত। আমার এখন মনে হচ্ছে, আগেই যদি আমি ফিনিশ করে দিতাম, তাহলে আমাকে আর মারার সুযোগই পেত না।'' ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে চান তরুণ প্রতিভা। 

এমন জাদু গোলের পর ময়দানে এখন অনুরণিত হচ্ছে, ''সাহিল হরিজন, নাম তো সুনা হি হোগা।'' তাঁর শুভাকাঙ্খীরা বলছেন, শুরু হয়েছে স্বপ্নের দৌড়, এই দৌড় যেন না থামে।