সম্পূর্ণা চক্রবর্তী
'করিম চাচা।' একযুগ আগে আই লিগ জমানায় ময়দানে অতি পরিচিত দুটো শব্দ। ৫-৩ গোলে ডার্বি জয়ের কোচকে আদর করে এই নামেই ডাকত মোহনবাগানিরা। এখনও দুটো শব্দ কানে বাজে করিম বেঞ্চারিফার। মাঝে ১৫ বছর কেটে গেলেও, মনে হয় সেদিনের কথা। সুদূর সিঙ্গাপুরে বসে ঝড়ের গতিতে এই কথাগুলো বললেন মরক্কোন কোচ।
বৃষ্টিমুখর সকাল। ডানার প্রভাব কলকাতায় সেইভাবে না পড়লেও শুক্রবার ভোর থেকে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। আজ থেকে ১৫ বছর আগে আরও একটি ঝড় আছড়ে পড়েছিল। কল্লোলিনীতে নয়, যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। তাতে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। চূর্ণ হয় অতীতের পাঁচ গোলের অধ্যায়। ২৫ অক্টোবর ২০০৯। মোহনবাগানিদের জীবনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি দিন। তারপর অনেক জল গড়িয়েছে। আই লিগ থেকে আইএসএলে উন্নীত হয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাব। বহু কোচ এসেছে, আবার চলেও গিয়েছে। কিন্তু করিম বেঞ্চারিফা মোহনবাগান ভক্তদের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তাঁর হাত ধরেই যে এক কলঙ্কময় অধ্যায় মুছে দিতে পেরেছিল মোহনবাগান। তৈরি হয়েছিল নতুন ইতিহাস। কলকাতা ছেড়েছেন এক দশক হয়ে গিয়েছে। ভারতীয় ফুটবলের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। কোচিং সূত্রে সিঙ্গাপুরে রয়েছেন। বর্তমানে সিঙ্গাপুর মহিলা দলের হেড কোচ। কিন্তু সেই রাত এখনও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। ফোনে করিম বলেন, 'সেদিনের ঐতিহাসিক রাত এখনও আমার চোখের সামনে ভাসছে। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবকিছু মনে আছে। ম্যাচের আগের প্রস্তুতি, খেলার গতিবিধি, জয়ের উন্মাদনা। সেই অনুভূতি ব্যাখ্যা করা যাবে না। আমি সমর্থকদের কাছে কৃতজ্ঞ। ৫-৩ ডার্বি জয়ের ১৫ বছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু দেড় যুগ পরেও মানুষ আমাকে মনে রেখেছে। এটা ভেবে খুবই ভাল লাগে। দারুণ অনুভূতি। এই প্রাপ্তি আমার কোচিং জীবনের সেরা সাফল্যের মধ্যে অন্যতম। আমার জীবনে এর গুরুত্ব অপরিসীম।'
দু'দফায় মোহনবাগানে কোচিং করিয়েছেন। প্রথমবার ২০০৮ সালে চার্চিল ব্রাদার্স থেকে কলকাতার প্রধানে যোগ দেন। সেবারই সবুজ মেরুনকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দেন। মাঝে এক বছর সালগাঁওকারে কাটিয়ে আবার ফেরেন তাঁর ছেড়ে যাওয়া বাগানে। ২০১৪-১৫ মরশুমে ভারতীয় ফুটবলে শেষবার দেখা যায় করিমকে। পুনে এফসির কোচ ছিলেন। তারপরও এক দশক কেটে গিয়েছে। ভারতীয় ফুটবলের সঙ্গে কোনও যোগ নেই। কিন্তু রয়েছে যোগসূত্র। সাপোর্টারদের মাধ্যমে। প্রতি বছর এই দিনটা তাঁকে মনে করিয়ে দেয় সেই ঐতিহাসিক রাত। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, ফিরে যান স্মৃতির সরণিতে। ক্ষণিকের জন্য হলেও ফেরেন ভারতে। ভারতীয় ফুটবলে। সোশ্যাল মিডিয়া ভরে যায় বার্তায়। কলকাতায় কোচিং করাকালীন সোশ্যাল মিডিয়ার ভক্ত ছিলেন না। নিজেকে দূরে রাখতেই পছন্দ করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। প্রত্যেক ২৫ অক্টোবর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুরিভুরি বার্তা পান। ঐতিহাসিক ডার্বির ১৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এবার সেটা যেন আরও বেড়েছে। সমর্থকদের এই ভালবাসাই তাঁকে আবার ভারতে ফেরার অনুপ্রেরণা জোগায়। করিম বলেন, 'সত্যি বলতে আমি ভাবতে পারিনি এত বছর কেটে গেলেও মোহনবাগান সমর্থকরা আমাকে এইভাবে মনে রাখবে, শ্রদ্ধা করবে। ফেসবুকে সাপোর্টাররা এখনও আমাকে মেসেজ পাঠায়। ঐতিহাসিক ডার্বির স্মৃতিচারণ করে। যা আমাকে এখনও কলকাতায় ফিরতে উদ্বুদ্ধ করে। আমার বিশ্বাস, আমি একদিন ফিরবোই এবং আরও একটি চিহ্ন রেখে যাব।'
নিয়মিত ভারতীয় ফুটবলের খবরাখবর রাখা হয় না। তবে চেষ্টা করেন। সচরাচর আইএসএল দেখার সুযোগ না পেলেও, খোঁজখবর রাখেন। আইএসএলে ইস্টবেঙ্গলের হাফ ডজন হারের কথা জানেন। মেনে নিলেন, ভারতীয় ফুটবল মিস করেন। বিশেষ করে কলকাতার ফুটবল। ইস্টবেঙ্গলের একটানা হারের কাটাছেঁড়া করতে চাইলেন না। গলদ ঠিক কোথায়, সেই নিয়েও কোনও মন্তব্য করতে চাননি এককালীন ময়দানের অন্যতম সেরা বিদেশি কোচ। তবে বরাবরই রসবোধ ভাল করিমের। ইস্টবেঙ্গল প্রসঙ্গ উঠতেই মজার ছলে বললেন, 'ওদের করিম চাচাকে নেওয়া উচিত। যে মোহনবাগানে টানা দশটা ম্যাচ জিতেছিল। সালগাঁওকারের একটানা হারের রেশ কাটিয়ে তাঁদের চ্যাম্পিয়ন করেছিল। কাপ দিয়েছিল।' ভারতীয় ফুটবল থেকে 'করিম চাচা' শব্দটা হারিয়ে গিয়েছিল। এদিন খোদ করিমের মুখে শুনে কিছুটা অবাকই লাগল। এখনও মনে রেখেছেন এই ডাকটা? প্রশ্ন করতেই মরক্কোন কোচের পাল্টা প্রশ্ন, 'কিছু জিনিস কি সত্যিই ভোলা যায়?'
