আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারতীয় ফুটবল কোন পথে! হংকংয়ের কাছে হারের পরে আরও একবার প্রশ্নটা উঠছে সর্বত্র।
এএফসি এশিয়ান কাপের যোগ্যতা পর্বের ম্যাচে ভারত হার মানল একেবারে শেষ মুহূর্তে গোল হজম করে। তার আগে চার-চারবার গোল করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছিল ভারত। কিন্তু কাপ আর ঠোঁটের ব্যবধান ঘুচল না! দিনান্তে মাথা নীচু করে মাঠ ছাড়তে হল।
মোহনবাগানের তারকা আশিক কুরুনিয়ান প্রথমার্ধে গোলকিপারের সঙ্গে হ্যান্ডশেক দূরত্বে বল পেয়েও গোল করতে পারেননি। দ্বিতীয়ার্ধে তাঁর শক্তিশালী বাঁ পায়ে বল পেয়েও লক্ষ্যভ্রষ্ট হন। আশিকের পরিবর্ত হিসেবে নামা সুনীল ছেত্রীও গোল করার সুযোগ পেয়ে ব্যর্থ হন।
লিস্টন কোলাসো হংকংয়ের পেনাল্টি বক্সের ভিতরে বল পেয়ে বাঁ পায়ে শট নিলেন তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। শেষের দিকে বিশাল কাইথ বল বের করতে না পেরে হংকংয়ের ফুটবলারের মুখে ঘুসি মেরে বসলেন। রেফারি পেনাল্টি দেন। আর ওই পেনাল্টি থেকে গোল করে হংকং এগিয়ে যায়। সেই গোল আর শোধ করতে পারেনি ভারত। বলা ভাল গোল হজম করার পরে যে অল্প সময় পেয়েছিল ভারত, তা সমতা ফেরানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল না।
ভারত-হংকং ম্যাচের গোল নষ্টের বন্যা দেখে ভারতে খেলে যাওয়া এক বিদেশি ফুটবলার বলছিলেন, ''গোলের সুযোগ তৈরি করলেও ভারতের ফুটবলাররা গোল করতে পারবেন না। কারণ তাঁদের টেকনিকে সমস্যা রয়েছে।''
তাঁর আরও সংযোজন, ''বিদেশিরা পাশে থাকলে ভারতীয়দের খেলারও উন্নতি ঘটে। মাঠের ভিতরে বিদেশি খেলোয়াড়দের নেতৃত্ব দেওয়া,তাঁদের দক্ষতা পার্থক্য গড়ে দেয়।''
একসময়ের সেই জনপ্রিয় বিদেশি ফুটবলারের কথা শুনে মনে হওয়াই স্বাভাবিক, তিনি ঠিকই বলছেন। ভুল কিছু বলছেন না। আইএসএলের দুনিয়ায় বিদেশি ফুটবলারের আধিক্য। প্রথম একাদশেই থাকেন চার জন বিদেশি ফুটবলার।
আজ বহুদিন হল বিদেশি ফুটবলারদের চারণভূমি হয়ে গিয়েছে শিবঠাকুরের দেশ। এই বিদেশিদের পায়েই ম্যাচের ভাগ্য তৈরি হয়। তাঁদের নিয়েই চলে মাতামাতি, তাঁদের নিয়েই হয় বীরপুজো।
দেশীয় ফুটবলাররা ম্যাচের রং বদলে দিচ্ছেন, গোল করছেন, ম্যাচ জেতাচ্ছেন এই দৃশ্য এখন খুব বেশি দেখা যায় না। আইএসএলের দৌলতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিয়ে আসা হয় বিদেশি ফুটবলারদের। এই দেশ তাঁদের অর্থ রোজগারের একটা মাধ্যম। এর বেশি কিছু নয়। এই বঙ্গের এক কোচ হতাশা নিয়ে বলতেন, ''নিজেদের দেশে যাঁরা কাজ পাননা, তাঁরাই আমাদের এখানে এসে কোচ হয়ে বসেন।''
হংকংয়ের বিরুদ্ধে লিস্টন কোলাসো, আশিক কুরুনিয়ান এবং বিশাল কাইথ একইসঙ্গে ভুল করে বসলেন। আর সেই ভুলের খেসারত দিতে হল জাতীয় দলকে। মনে প্রশ্ন জাগে জাতীয় দলের এই তারকারাই তো আইএসএলের সৌজন্যে সারা বছর বিদেশি কোচের অধীনে থাকেন। তাহলে মাঠে নেমে এত ভুল হয় কী করে? এই বিদেশি কোচদের থেকে তাঁরা কী শিখছেন?
কোলাসো, আশিকের গোল নষ্ট করার ধরন দেখে মনে হচ্ছিল প্রাক্তন সেই বিদেশি ফুটবলারই ঠিক। টেকনিকে গলদ রয়েছে, নইলে এত সহজ সুযোগ নষ্ট করবেন কেন! আইএসএলের প্রতিটি দলে বিদেশি ফুটবলার খেলেন। বিদেশি ফুটবলারদের পাশে দেশীয় ফুটবলারদের দেখে মনে হয়,তাঁরাও একেকজন 'দৈত্য'।
সন্দেশ, আনোয়ার, অভিষেক সিং, ব্র্যান্ডন, ছাংতে এঁদের আইএসএলের দুনিয়ায় একরকম লাগে, দেশের হয়ে নামলে বদলে যায় তাঁদের খেলা। একবারে পাঁচটা পাসও ঠিক হয় না। ক্লাব আর দেশের হয়ে খেলায় এত বিস্তর পার্থক্য কেন?
লিস্টন, আশিক, বিশাল, এই তিন তারকা আইএসএলে মোহনবাগানের হয়ে খেলেন। দেশের সেরা লিগে মোহনবাগান চ্যাম্পিয়ন। ধরাছোঁয়ার বাইরে তাঁরা। জাতীয় দলের বাছাই করা তারকা স্বদেশি ও দুর্দান্ত মানের বিদেশি ফুটবলারদের নিয়ে দল গড়ে মোহনবাগান। তাঁদের বেতনও আকাশছোঁয়া। আইএসএলের পৃথিবীতে তাঁদের রুখবে কে! মোহনবাগান অপ্রতিরোধ্য।
ভাল দল গড়ার একটা ভাল দিক রয়েছে। তাৎক্ষণিক ফলাফল মেলে তাতে। ঘরোয়া টুর্নামেন্টে প্রাধান্য রেখে জেতা যায়। বড় সড় ট্রফি ঘরে ওঠে। কিন্তু সুদূরপ্রসারী ফলাফল খারাপ হতে বাধ্য। যেমন এই ফুটবলাররাই দেশের হয়ে যখন আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলতে নামছেন, তখন তাঁদের মান পড়ে যাচ্ছে ঝু-উ-উ-প করে। বেরিয়ে পড়ছে খুঁত। করে ফেলছেন ভুলের পর ভুল। সেই ভুল ঢাকবেন কে? দলে কি আছেন ভুল ঢাকার মতো কেউ?
ভাল ফুটবলারের পাশে খেললে ধরা পড়ে না ভুল।
মোহনবাগানে আশিক,কোলাসোদের পাশে কারা খেলেন? ম্যাকলারেন, পেত্রাতোস, কামিন্স। তাঁদের পাশে বাকিরাও হাজার ওয়াটের আলো ছড়ান।
দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচে তো আর ম্যাকলারেন,কামিন্সরা খেলেন না। কাইথের আগে ডিফেন্স আগলান না অলড্রেড বা আলবার্তোর মতো সুঠাম-শক্তিশালী বিদেশি ডিফেন্ডাররাও। তাই জাতীয় দলের জার্সিতে বেরিয়ে পড়ে কঙ্কাল।
মোহনবাগান আইএসএলের লিগ-শিল্ড এবং আইএসএল চ্যাম্পিয়ন। গত কয়েকবছরে সবথেকে ধারাবাহিক দলের নাম মোহনবাগান। এই প্রতিবেদনে তাদের সাফল্যকে খর্ব করা হচ্ছে না। মোহনবাগান কেবল একটা উদাহরণ মাত্র।
আইএসএলের বাকি দলগুলোতেও সেই একই মডেল অনুসৃত। সবুজ-মেরুনের মতো সাফল্য পায় না। কিন্তু অতিরিক্ত বিদেশি নির্ভরতা ঢুকে পড়ছে তাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। দেশের সেরা লিগে সংশ্লিষ্ট ক্লাবের ফুটবলাররা দাপিয়ে খেলেন। কিন্তু সেই তাঁরাই যখন জাতীয় দলের জার্সিতে নামেন, তাঁদের কেমন যেন নির্বিষ দেখায়। মনে হয় বিষদাঁতটাই কে যেন ভেঙে দিয়েছে!
কথায় বলে আলোর নীচেই থাকে অন্ধকার। আইএসএলের উজ্জ্বল আলোয় পথ হারাচ্ছে ভারতীয় ফুটবল। দেশের সেরা লিগ থেকে একটুও যে উন্নতি হয়নি দেশীয় ফুটবলের, তা আজ দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। ক্লাবের জার্সিতে যাঁরা হিরো, দেশের জার্সিতে তাঁরাই জিরো। একথা বললেও অত্যুক্তি করা হবে না একটুও।
