উদ্দালক
'তাহারা পরস্পরকে আর বুঝি ছাড়িতেও পারিবে না। প্রেম নয়, তাহার চেয়েও তীব্র, তাহার চেয়েও গভীর উন্মাদনার বিদ্বেষ ও বিতৃষ্ণার শৃঙ্খলে তাহারা পরস্পরের সহিত আবদ্ধ। সে শৃঙ্খল তাহারা ছিঁড়িলে আর বাঁচিবার সম্বল কি রহিল - জীবনের কি আশ্রয়? পরস্পরের জন্য় তাহারা বাঁচিযে থাকিতেও চায়।' প্রেমেন্দ্র মিত্রের এই অসামান্য গল্পটি যেখানে শেষ রুদ্রজিৎ রায়ের 'পিঞ্জর' সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করে। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বেঙ্গলি প্যানোরামা বিভাগে এই ছবি দেখানো হল রবীন্দ্রসদনে। শহর থেকে গ্রাম, সম্পর্কের সমীকরণ আর প্রতীকময়তায় পূর্ণ এই ছবি বারবার ধরতে চেয়েছে বিভিন্ন বয়সের মানুষের বিভিন্ন মানবিক স্তরকে। আর ছবির পর দর্শকদের প্রতিক্রিয়াই প্রমাণ করে দিচ্ছে ছবিটি ছুঁয়েছে সকলকেই।

এই ছবির ক্ষেত্রে গল্পটাই মুখ্য। গল্পের চলনে বিভিন্ন প্রতীক ব্যবহার করেছেন পরিচালক রুদ্রজিৎ। শহরের পরিবার, উচ্চবিত্তের সম্পর্কের জটিলতা ও সংকট থেকে শুরু করে আর্থিক প্রান্তিকতায় থাকা মানুষদের মধ্যে সযত্নে লালন করা ভালবাসা ও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইকে পর্দায় এনে প্রতিষ্ঠা করে দৃশ্যকল্প তৈরি করেছেন তিনি। একদিকে তারক বেরা, ঝিমলি অন্যদিকে পারমিতাদের গল্প এই ছবিতে ধীরে ধীরে জালের মতো এক আবহ রচনা করে। যে আবহের তরঙ্গে ধীর গতিতে দর্শক ঢুকে পড়ে নিত্য সম্পর্কের যাত্রার যাত্রী হয়ে। মানুষ ও তার সংকটের বিস্তারিত, নিখুঁত ও মাইক্রোস্কোপিক বিশ্লেষণ করতে থাকেন ছবির পরিচালক ও চরিত্ররা। তাঁদের তাকানো, সংকটের অভিমান, বিক্ষোভে ফেটে পড়া রাগ সেই যাত্রাকে সাত ঋতুর মতো নানা অনুভূতির মধ্যে দিয়ে নিয়ে যায় পুরো সিনেমা জুড়েই।

রুদ্রজিৎ পেশায় একজন চিকিৎসক। এখানেও তিনি চিকিৎসা করলেন বটে, তবে তা মানুষের মনের। ভগ্ন, ক্লান্ত শহর মনকে তিনি এই ছবির মাধ্যমে সরলরেখায় এনে দিলেন। দাঁড় করালেন শান্ত কোনও বিকেলের কাছে, যেখানে অবসন্ন মানুষ চেয়ে দেখতে পারে তার চারপাশের বিভিন্ন থাকা-না থাকা সম্পর্ক ও আত্মীয়তাকে। যেখানে মানুষ যাচাই করতে পারে, কার জন্য কাঁদা উচিত, কার জন্য নয়। আসলে যে পিঞ্জর বা খাঁচার রূপকল্প পরিচালক রুদ্রজিৎ তৈরি করেছেন, সেই রূপকল্পে তিনি হয়ত সম্পর্কের নানা সমীকরণকে বোঝাতে চেয়েছেন, কিন্তু সবটা তো তা নয়। এই মানব জন্মের প্রায় পুরোটাই তো পিঁজরায় আঁটা এক নিত্যতা। সেখানে আটকে থাকাটাই নিয়ম, তাই দর্শক হয়ত সেই ছেলেটির কথাটিও মনে করে রাখেন শেষ পর্যন্ত, যাঁর মাসিক বেতন ২০ হাজারের কম, যে ভাবে তাঁর বিবাহিত প্রেমিকা আর প্রেমিকার সন্তানকে নিয়ে সে সংসার করবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারে না, কোথায় আটকে পড়ে সে, আটকে পড়ে কোন খাঁচায়?

ছবিতে সঙ্গীতের ব্যবহার অসামান্য। রবীন্দ্রনাথের গানের ব্যবহার চমকে দেওয়ার মতো। আসলে রবীন্দ্রনাথের গানেরও তো বিভিন্ন স্তর আছে। মুড ব্যতিরেকে সেই গানের ব্যবহার বিভিন্ন দৃশ্যকল্পে বিভিন্ন অর্থ তৈরি করে। এই ছবিতেও রবীন্দ্রনাথের গানের সম্পূর্ণ অন্য এক অর্থ তৈরি করেছে। এখানে গানটির উল্লেখ করে দেওয়া ঠিক নয়, কারণ তাহলে সেই আশ্চর্য মুহূর্ত মাটি হতে পারে। তবে উল্লেখ করতেই হচ্ছে, সেই মুহূর্ত ছবিটির একটি চরম উল্লেখযোগ্য সময়, গুরুত্বপূর্ণও। ছবিতে অসামান্য অভিনয় করেছেন সাগ্নিক মুখার্জি, শতাক্ষী নন্দীরা। সাগ্নিক যেভাবে দূরবর্তী চরিত্রকে নিজের করে নিয়ে গড়ে তুলেছেন, সেটি দেখলে অভিনয়ের ছাত্র হিসাবে হিংসা হয়। যে বিশাল-বিশাল স্কেপে চরিত্রদের স্থাপন করেছেন পরিচালক, সেখানে লড়াই করে নিজেকে অভিনেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ে এরা সকলেই প্রায় সফল হয়েছেন। উল্টোদিকে নাগরিক জীবনের অস্তিত্বের যে সংকট, সেই সংকটকে অদ্ভুত দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন অভিনেত্রী মল্লিকা। তাঁর চলন ছবির সম্পদ।

শহরের নিয়ন আলো আর ধুলো, ধোঁয়ার মধ্যে ক্লান্তি মেঘের মতো ঘিরে রাখে আমাদের। আমরা তবু চলি। চলতে চলতে কখনও কখনও এসে বসি পিঞ্জরের মতো কোনও সিনেমার কাছে। সেই সিনেমা জুড়ে আলাগা রোদের মতো ছড়িয়ে থাকে আদর। যে আদরের অপেক্ষা করে আছি আমরা চাতকের মতো। সেই চাতকের অনন্ত তৃষ্ণা কখনই ফুরোবে না, তবে মৌসুমি বায়ুর মতো কখনও কখনও রুদ্রজিতের ছবি আসবে, আমরা সেই সামান্য জল পান করে ক্ষণিকের শান্তি পাব।
