আজকাল ওয়েবডেস্ক: ২০ নভেম্বর ভারতের ফেডারেল কাঠামোর পক্ষে সুখকর দিন প্রমাণিত হয়নি। কারণটি বিশ্লেষণ করে দেখলে বোঝা যায়—বিহারে দশমবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়া কোনও আঞ্চলিক নেতার রাজনৈতিক কারিকুরি নয়, বরং সুপ্রিম কোর্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়, যা দেশজুড়ে কেন্দ্র–রাজ্য সম্পর্কের সূক্ষ্ম ভারসাম্যকে নড়বড়ে করে দিল।
একটি সাংবিধানিক বেঞ্চ নিজেদেরই ১১ এপ্রিলের রায় উল্টে দিল। ওই রায়ে বিচারপতি জে.বি. পারদিওয়ালা ও বিচারপতি আর. মহাদেবন স্পষ্ট জানিয়েছিলেন—রাষ্ট্রপতি হোক বা রাজ্যপাল, কোনও অবস্থাতেই একটি রাজ্যের বিধানসভা বা সংসদে পাস হওয়া বিল ‘অনির্দিষ্টকালের’ জন্য আটকে রাখতে পারবেন না।
এই রায় এসেছিল তামিলনাড়ুতে কেন্দ্র-নিযুক্ত রাজ্যপাল ও নির্বাচিত ডিএমকে সরকারের দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থার প্রেক্ষাপটে। ২০১৪-র পর থেকে বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিকে ‘শাসন’-এর নামে কেন্দ্র যেভাবে অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, এ সংঘাত তারই একটি রাজনৈতিক নিদর্শন। বিশেষত, বিজেপি-নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র রাজভবনগুলিকে বিরোধী রাজ্য সরকারগুলির বিরুদ্ধে অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার করেছে—এমন অভিযোগ বিরোধী শিবিরে বহুদিনের।
কেন্দ্রীয় সরকার প্রেসিডেনশিয়াল রেফারেন্সে জোর দিয়েছিল কারণ পারদিওয়ালা-মহাদেবন রায়ের ফলে তাদের নিয়ন্ত্রণের বলদণ্ড কিছুটা আলগা হয়ে গিয়েছিল। নন-বিজেপি রাজ্যগুলিতে ‘পকেট ভেটো’ বা বিল আটকে রাখার কৌশল রাজ্যপালদের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। অস্পষ্ট সাংবিধানিক ফাঁকফোকরগুলোকে রাজভবনগুলি সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করছিল।
সাংবিধানিক বেঞ্চ এখন কঠোর টেক্সচুয়াল রিডিং-এর ভিত্তিতে আগের রায় বাতিল করেছে। বিচারালয় জানিয়েছে—তারা কোনওভাবেই রাজনৈতিক সক্রিয়তার ভূমিকায় যেতে চায় না, আইনসভার বা নির্বাহী বিভাগের রাজনৈতিক অতিরিক্ততা সংশোধনের দায়িত্ব তাদের নয়। সর্বসম্মত রায়ের সুরেই স্পষ্ট—বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক সংঘর্ষে নিজেকে জড়াতে নারাজ।
কিন্তু এই ‘আত্মসংযম’-এর আড়ালে আদালত যেন তাদের গভীরতর সাংবিধানিক দায়িত্ব—ফেডারেল ভারসাম্য রক্ষা—সেটিকে উপেক্ষা করল। সমালোচকদের মতে, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে জরাজীর্ণ 'এডিএম জবলপুর' যুগের টেক্সচুয়াল পবিত্রতার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে, যদিও বিচারব্যবস্থা সেই সময়কে বহু আগেই অতিক্রম করেছে।
পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মনসুর আলি শাহ তাঁর পদত্যাগপত্রে লিখেছিলেন, “যেখানে ন্যায়বিচার বাধাপ্রাপ্ত, সেখানে জাতি শুধু ব্যর্থ হয় না—নৈতিক দিশাও হারায়।” ভারতে আজ সেই সতর্কবার্তাই যেন ফিরে আসছে।
নতুন রায় বাস্তবে পুরনো সমস্যাই পুনরুজ্জীবিত করল। রাজ্যপালরা ‘সুপার মুখ্যমন্ত্রী’ নন—বেঞ্চ এ কথা স্পষ্ট করলেও প্রশ্ন রয়ে গেল: একটি বিরূপ, রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট রাজ্যপাল যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বিল আটকে রাখেন, তখন ‘অযৌক্তিক বিলম্ব’ বা ‘অনির্দিষ্ট অপেক্ষা’র সংজ্ঞা কে দেবে?
ভারতের সংবিধান একটি রাজনৈতিক চুক্তি—বৈচিত্র্য, সমঝোতা ও ন্যায়বোধের ভিত্তিতে নির্মিত। এর প্রাণশক্তি নিহিত ভারসাম্যে: কেন্দ্র-রাজ্য, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু, নাগরিক-রাষ্ট্র, ব্যক্তিস্বার্থ-জনস্বার্থ—সব ক্ষেত্রেই।
সেই ভারসাম্যেই যখন চিড় ধরে, গণতন্ত্র দুর্বল হয়।
সাত দশকের অভিজ্ঞতা বলে—প্রাতিষ্ঠানিক একতরফা শক্তিবৃদ্ধি শেষ পর্যন্ত ব্যয়বহুল ভুলের জন্ম দেয়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্যর্থ হলে, বিচারব্যবস্থারই দায়িত্ব থাকে অতিরিক্ত ক্ষমতার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হয়ে ওঠা। সদ্যপ্রকাশিত প্রেসিডেনশিয়াল রেফারেন্স রায় সেই আস্থাকে জোরদার করতে পারল না—বরং আরও প্রশ্ন তুলে দিল ভারতের ফেডারেল গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
