সৌরভ গোস্বামী: ধর্মের ইতিহাস সাধারণত অলৌকিকতা, বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার ভাষায় লেখা হয়। কিন্তু ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস তাঁর On the History of Early Christianity প্রবন্ধে এই ধারাকে ভেঙে দেন। তাঁর যুক্তি ছিল স্পষ্ট- খ্রিস্টধর্ম কোনও আকাশ থেকে নেমে আসা ঘটনা নয়, বরং রোমান সাম্রাজ্যের গভীর সামাজিক সংকট থেকে জন্ম নেওয়া এক নিপীড়িত শ্রেণির আন্দোলন। ধর্ম এখানে আধ্যাত্মিক আশ্রয় হলেও, তার শিকড় ছিল বস্তুগত জীবনে।
যিশুর জন্ম ও জীবন এই বাস্তবতার মধ্যেই গড়ে ওঠে। তিনি জন্মেছিলেন রোমান শাসনের অধীন প্যালেস্টাইনের এক দরিদ্র পরিবারে, ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে বহু দূরে। চারপাশে ছিল দাসপ্রথা, অতিরিক্ত কর, ভূমি বন্টনে ছিল চরম বৈষম্য এবং ধর্মীয়-রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অত্যাচার। এই অবস্থায় যিশুর বাণী অর্থ ও ক্ষমতার বিপরীতে দাঁড়িয়েছিল। দরিদ্র ও নিপীড়িতদের তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে ন্যায়ের এক নতুন রাজ্য আসছে যেখানে বর্তমান শাসনের কোনও অধিকার থাকবে না। এঙ্গেলসের চোখে যিশু ছিলেন কোনও বিমূর্ত ধর্মগুরু নন, বরং শোষিত মানুষের নৈতিক প্রতিবাদের প্রতীক।
যিশুর মৃত্যুর পর যে প্রাথমিক খ্রিস্টধর্ম গড়ে ওঠে, তা ছিল দাস, মুক্তদাস, দরিদ্র কারিগর, ভূমিহীন কৃষক ও উপনিবেশিক জনগোষ্ঠীর ধর্ম। এই আন্দোলন জাতি ও বর্ণের সীমা ভেঙে সকলকে এক নৈতিক সমতার প্রতিশ্রুতি দেয়- “দাস বা স্বাধীন, ইহুদি বা গ্রিক”-এই বিভাজন ঈশ্বরের সামনে অর্থহীন। কিন্তু এই সমতা বাস্তব জীবনে নয়, প্রতিশ্রুত ছিল ভবিষ্যতের এক ঈশ্বরের রাজ্যে। এঙ্গেলস ব্যাখ্যা করেন, প্রাচীন বিশ্বে রাজনৈতিক বিপ্লবের ধারণা বা সংগঠিত শ্রেণিসংগ্রামের পথ না থাকায় মানুষের ক্ষোভ ও আকাঙ্ক্ষা ধর্মীয় ভাষাতেই প্রকাশ পেয়েছিল। পরকালের মুক্তি ছিল এই জগতের অসহায়তার প্রতিফলন।
এখানেই এঙ্গেলস প্রাথমিক খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে আধুনিক বামপন্থার একটি তাৎপর্যপূর্ণ তুলনা টানেন। উভয়ই নিপীড়িতদের মধ্য থেকে উঠে এসেছে, উভয়ই বিদ্যমান শাসনব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তিকে প্রশ্ন করেছে এবং উভয়ই সর্বজনীন মুক্তির কথা বলেছে। তবে মৌলিক পার্থক্যটি স্পষ্ট-খ্রিস্টধর্ম মুক্তিকে স্বর্গে সরিয়ে দেয়, আর বামপন্থা মুক্তিকে ইতিহাসের বাস্তব কাজ হিসেবে এই পৃথিবীতেই স্থাপন করে। একদিকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রতিবাদ, অন্যদিকে বস্তুগত ও রাজনৈতিক সংগ্রাম।
খ্রিস্টধর্ম যখন রাষ্ট্রধর্মে পরিণত হয়, তখন তার চরিত্র আমূল বদলে যায়। যে ধর্ম একদিন নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, সেই ধর্মই শাসনের বৈধতা দিতে শুরু করে। আনুগত্য ও দুঃখভোগকে মহৎ গুণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়, আর প্রাথমিক সাম্যবাদী চেতনাকে বদল করে গির্জার শ্রেণিবিন্যাস। এঙ্গেলস দেখান, এটি কোনও ধর্মীয় ব্যতিক্রম নয়- ইতিহাসে বহু বিপ্লবী আন্দোলন ক্ষমতার কাঠামোর অংশ হয়ে পড়ে এমনই রূপান্তরের শিকার হয়েছে।
আজকের দুনিয়ায় এঙ্গেলসের এই বিশ্লেষণ তাই গুরুত্বপূর্ণ। এটি মনে করিয়ে দেয় যে আদর্শ, নৈতিকতা বা ধর্মীয় বিশ্বাস সবসময়ই নির্দিষ্ট সামাজিক বাস্তবতার সন্তান। যিশু ও প্রাথমিক খ্রিস্টধর্ম নিপীড়িত মানুষের যন্ত্রণাকে প্রথমবার এক শক্তিশালী ভাষা দিয়েছিল, কিন্তু সেই ভাষা শোষণের কাঠামো ভাঙতে পারেনি। বামপন্থার ঐতিহাসিক দায়িত্ব এখানেই আলাদা- স্বর্গের প্রতিশ্রুতি নয়, বরং এই পৃথিবীতেই ন্যায় ও মুক্তির বাস্তব নির্মাণ।
