ভালবাসা মানে শুধু সম্পর্ক নয়, বিশ্বাসের বন্ধনও বটে। এই ‘বিশ্বাস’ এমন একটি বিষয় যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অস্তিত্ব রয়েছে সর্বত্র। আবার এমনই ভঙ্গুর যে নিমেষে ভেঙে যেতে পারে।আসলে যে কোনও সম্পর্কের ভিত্তি হল বিশ্বাস। সে প্রেম হোক বা বন্ধুত্ব কিংবা অভিভাবকত্বের সম্পর্ক। আর বিশ্বাস একবার ভেঙে গেলে নতুন করে কাউকে ভরসা করতে অনেক সময়েই এক অজানা দ্বন্দ্ব, ভয় গ্রাস করে। পুরনো তিক্ত অভিজ্ঞতা এমন আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরে যে সেই বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে নতুন সম্পর্কে এগোনো প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে।

অতীতের বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা বা গভীর মানসিক আঘাত থেকে অনেকে এমন ভয় বা ট্রমার শিকার হন যে পরবর্তীকালে আর অন্য কাউকে বিশ্বাস করতে পারেন না। যা বিশেষ করে প্রেমের সম্পর্কে আরও প্রবল হয়ে ওঠে।চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই অবস্থাকে বলা হয় ‘পিস্ট্যানথ্রোফোবিয়া’ অর্থাৎ অন্যের প্রতি বিশ্বাস হারানোর ভয়। ‘আবার যদি একই ঘটনা ঘটে’! সেই ভয়ই পরবর্তীকালে নতুন কাউকে বিশ্বাস করতে বাধা দেয়। 

সকলের অবশ্য এই একই রকম ভয় বা ‘ফোবিয়া’ থাকে না। যদি কেউ একেবারে নতুন সম্পর্কে যেতে না পারেন, সেই পরিস্থিতিকে 'ভয়' বলা যায়৷ সাধারণত কোনও কিছুর অভিজ্ঞতায় শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন হলে তাকে  ‘ফোবিয়া’ বলে। তবে এক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন বেশি হয়। রাগ, আক্রোশ বাড়তে থাকে। এমনকী আঘাতের ক্ষত ঢাকতে অনেকে শুধুমাত্র প্রাক্তনকে দেখানোর জন্য নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ইদানীং এই ট্রেন্ড বেশি নজরে আসছে। খানিকটা সেই কারণেই আজকাল সম্পর্কে স্থায়িত্ব কমে গিয়েছে। আবার কেউ কেউ আগের সঙ্গীর অস্তিত্ব খুঁজে পেতে চেষ্টা করেন নতুন সঙ্গীর মধ্যে। ফলে অতীত-বর্তমানের সম্পর্ক নিয়ে মনের মধ্যে চলতে থাকে একটা টানাপড়েন।

আগে জেনে নেওয়া যাক কেন স্মৃতি পিছু ছাড়তে চায় না। আসলে বিশ্বাস ভাঙার কষ্ট মস্তিষ্কে গভীর প্রভাব ফেলে। ভালবাসার সম্পর্কে থাকাকালীন মস্তিষ্কে ‘হ্যাপি হরমোন’ যেমন ডোপামিন ও অক্সিটোসিনের নিঃসরণ বাড়ে। এই হরমোন আনন্দ ও নিরাপত্তার অনুভূতি দেয়। কিন্তু সম্পর্ক যখন ভেঙে যায় তখন সেই অনুভূতি থেকেই ভয়, সন্দেহ এবং মানসিক প্রতিরোধের জন্ম নেয়। নতুন সম্পর্কে ফের প্রতারিত হওয়ার ভয়েই নিজেকে এক খোলসের মধ্যে ঢুকিয়ে নেন অনেকে। কেউ নতুন মানুষকে মনের দরজা খোলার সুযোগই দেন না, কারওর নিজের ইতিবাচক অনুভূতিও অতীতের ভয়ের চোখরাঙানির কাছে হেরে যায়৷ এমন বিশ্বাস ভাঙা, ফের বিশ্বাস করতে না পারার অজস্র নজির আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। তবে পিস্ট্যানথ্রোফোবিয়া কোনও দুর্বলতা নয়, বরং এক ধরনের মানসিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যা অতীতের আঘাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে চায়। তবে এই ভয় যদি সম্পর্ক শুরুর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তখন তা ভাঙা জরুরি বই কী! 

আরও পড়ুনঃ এবার চোখ বন্ধ করেও দেখবেন স্পষ্ট! চীনের নতুন কনট্যাক্ট লেন্সে অন্ধকারেও ঝাপসা হবে না দৃষ্টিশক্তি


লক্ষণ চিনুন

সাধারণত এই সমস্যায় ভুক্তভোগীদের আচরণে কিছু স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যায়। তাঁরা নতুন সম্পর্কে জড়াতে চান না কিংবা কেউ কাছে এলে অস্বস্তিবোধ করেন। নতুন মানুষদের প্রতি অযৌক্তিক সন্দেহ, ঘনিষ্ঠতা এড়িয়ে চলা বা কথোপকথনে দূরত্ব বজায় রাখতে চান। অনেক সময় কষ্ট পাওয়ার ভয়ে নিজের আবেগ প্রকাশ করতে ভয় পান, ব্যক্তিত্বেও সমস্যা দেখা দেয়। এঁরা নিজেকে গুটিয়ে রাখেন, ক্রমশ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠেন, পুরনো সম্পর্কের থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টায় হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

নিজেকে বুঝুন

নিজের সমস্যা আগে নিজেকেই বুঝতে হবে৷ যে কোনও বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব রাখার চেষ্টা করুন৷ সম্পর্ক ভেঙে গেলে আঘাত পাওয়া স্বাভাবিক কিন্তু একটি সম্পর্ক গোটা জীবনের মূলমন্ত্র নয়। নিজেকে দ্বিতীয় সুযোগ দিন। প্রাক্তনের কোনও তীর্যক মন্তব্য মনের মধ্যে গেঁথে রেখে আখেরে কোনও লাভ নেই। বরং কোনও নেগেটিভ মুহুর্তকে উপেক্ষা করতে নিজের ব্যক্তিত্বের পজিটিভ বিকাশ ঘটান। অতীতে নিজের তরফে কোনও ভুল থাকলে তা বর্তমান সম্পর্কে প্রথম থেকে সজাগ থাকুন। মনের যে কোনও সমস্যা নিয়ে বন্ধু কিংবা কাছের মানুষদের সঙ্গে কথা বলুন। 

সকলে একরকম নয়

প্রত্যেক মানুষ আলাদা। সকলেরই পৃথক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে। আগের মানুষটির প্রতারণার দায় নিশ্চয়ই নতুন মানুষটির নয়।  বরং বর্তমান সম্পর্কে প্রথম থেকে অবিশ্বাসের বীজ বপন করলে জটিলতা আরও বাড়বে।জীবনের নতুন সদস্যকে খানিকটা সময় দিন৷ মনের মধ্যে আগে থেকে ধারণা তৈরি করে মিশবেন না।

তাড়াহুড়ো নয়, ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত

প্রেমে পড়লে আগে-পিছনে ভাবনার অবকাশও থাকে না ঠিকই, কিন্তু দ্বিতীয়বার একটু সতর্ক না হলেই নয়। তাই তাড়াহুড়ো না করে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিন। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার আগে সঙ্গীকে ভাল করে চিনে নিন। বার বার আঘাত পাওয়ার চেয়ে সময় নিয়ে এগোনোই শ্রেয়। 

স্বচ্ছ থাকুন 

সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা অত্যন্ত জরুরি। নিজের  আগের কোনও ভুল নিয়ে প্রথমেই মন খুলে কথা বলুন। অনেকের মধ্যে ‘হারানোর’ ভয়ে গোপন করার প্রবণতা থাকে। কিন্তু সাময়িক গোপনীয়তা পরে প্রকাশ্যে এলে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। 

বর্তমানে বাঁচুন

নতুন প্রেমে যেমন আগের প্রেম সম্পর্কে অসম্মানসূচক মন্তব্য করা উচিত নয়, তেমনই তুলনা টানাও ঠিক নয়। অনেকেই নতুন মানুষটিকে খুশি করতে আগের সম্পর্ক ও সঙ্গীর সম্পর্কে হেয় মন্তব্য করেন যা বর্তমান সঙ্গী ভালভাবে নাও নিতে পারেন। একইসঙ্গে প্রাক্তনের সঙ্গে নতুন সঙ্গীর তুলনা সম্পর্কের জন্য মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়।

বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন

নিজে সমাধান করতে না পারলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে সমস্যা কোন পর্যায়ে রয়েছে তার ওপর নির্ভর করে কাউন্সেলিং কিংবা থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। যদি নিজের মানসিক অবস্থার কারণে খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে যান কিংবা আক্রমণাত্বক হয়ে পড়েন অর্থাৎ নিজের বা প্রিয়জনেদের ক্ষতি করার কিংবা জিনিসপত্র নষ্ট করারা প্রবণতা দেখা দেয় তাহলে মনোচিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেতে হতে পারে। আশেপাশের মানুষও যদি এই ধরনের ব্যবহারগত অস্বাভাবিক পরিবর্তন খেয়াল করেন তাহলে সাহায্যের হাত এগিয়ে দেওয়া উচিত।

শেষে বলতে হয়, ভালবাসা ক্ষত নিরাময়ের একমাত্র পথ। তাই হয়েতো সময়ের সঙ্গে আঘাত শুকিয়ে গেলে একদিন আবার কেউ এসে বলবে, “বিশ্বাস করতে পারো...” খোলা মনে হাত বাড়িয়ে দিন।