সোশ্যাল মিডিয়া-নির্ভর ওয়েলনেস ট্রেন্ডের যুগে হার্বাল ডিটক্স চা এখন কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। শরীর ‘পরিষ্কার’ করা ও দ্রুত সুস্থতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই চাগুলি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু চিকিৎসকরা এখন সতর্ক করছেন, যাঁদের আগে থেকেই লিভারের সমস্যা রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এই তথাকথিত ‘প্রাকৃতিক’ উপায় উল্টে আরও বেশি ক্ষতি করতে পারে। অনেক সময় এই চাগুলি যে বিষাক্ত উপাদান দূর করার দাবি করে, তার থেকেও বেশি ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।

চিকিৎসকদের মতে, বহু হার্বাল পণ্যে ভারী ধাতু বা লেবেলে উল্লেখ না থাকা উপাদান থাকার ঝুঁকি থাকে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, নিয়ন্ত্রণহীন এই মিশ্রণগুলির সঙ্গে গুরুতর লিভার ক্ষতি, লিভার ফেলিওর, এমনকি চরম পরিস্থিতিতে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনের ঘটনাও ক্রমশ বাড়ছে।

‘দ্রুত সমাধান’-এর ভুল ধারণা
ডা. সুদীপ খান্না জানান, লিভার নিজেই একটি অত্যন্ত কার্যকর ডিটক্সিফাইং অঙ্গ। তাঁর কথায়, “অনেকে শরীর পরিষ্কার করার আশায় হার্বাল ডিটক্স চায়ের দিকে ঝোঁকেন। এগুলি দ্রুত ফলের প্রতিশ্রুতি দিলেও, লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত উপাদান ও নিয়ন্ত্রণের অভাবে লিভারের ক্ষতি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।”
ফ্যাটি লিভার, হেপাটাইটিস বা সিরোসিসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এই হার্বাল উপাদান প্রক্রিয়াকরণের অতিরিক্ত চাপ দ্রুত লিভার ফেলিওরের কারণ হতে পারে। চিকিৎসকদের স্পষ্ট পরামর্শ, যাঁদের লিভারের সমস্যা রয়েছে, তাঁরা চিকিৎসকের দেওয়া চিকিৎসা ও খাদ্যাভ্যাসেই ভরসা রাখুন। লিভার নিজেই শরীর পরিষ্কার করার জন্য তৈরি, তার জন্য কোনও চায়ের দরকার নেই।

লিভারের ক্ষতির পাঁচটি বড় কারণ
ডা. খান্না হার্বাল ডিটক্স চায়ের কারণে লিভার ক্ষতির পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ তুলে ধরেছেন

বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান
কিছু হার্বে থাকা পাইরোলিজিডিন অ্যালকালয়েড সরাসরি লিভার কোষের ক্ষতি করতে পারে। এগুলি লিভারের রক্তনালি বন্ধ করে দিতে পারে, যার ফলে দ্রুত অবনতি ঘটে। যাঁদের আগে থেকেই লিভার দুর্বল, তাঁদের পক্ষে এই বিষক্রিয়া সামলানো আরও কঠিন।

অতিরিক্ত মাত্রার এক্সট্র্যাক্ট
ডিটক্স চায়ে ব্যবহৃত ঘন গ্রিন টি এক্সট্র্যাক্টে অনেক সময় দৈনিক ৮০০ মিলিগ্রামেরও বেশি ইসিজিসি থাকে। সাধারণ গ্রিন টি নিরাপদ হলেও, এই ডোজ লিভার এনজাইম বাড়িয়ে জন্ডিস ও বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে।

নিয়ন্ত্রণহীন মিশ্রণ
সেন্না, ড্যান্ডেলিয়ন, নেটল ইত্যাদি একাধিক হার্ব একসঙ্গে মেশানো চায়ের নিরাপত্তা পরীক্ষা প্রায়ই হয় না। এগুলির সঙ্গে কোলেস্ট্যাটিক হেপাটাইটিসের মতো সমস্যার যোগ পাওয়া গিয়েছে।

দুর্বল লিভারের উপর বাড়তি চাপ
অনেক ডিটক্স চায়ে জোলাপ বা মূত্রবর্ধক উপাদান থাকে, যা শরীরকে ডিহাইড্রেট করে ও ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য নষ্ট করে। এতে আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত লিভারের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে।

ডা. খান্না জানান, ডিটক্স চা লিভারের ক্ষতি সারাতে পারে, এমন কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। সিরোসিসের মতো সমস্যায় প্রকৃত চিকিৎসা আসে ওষুধ ও নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস থেকে, কোনও ট্রেন্ডি চা থেকে নয়।

ডা. রাজেশ্বরী ভি শেট্টি জানান, হার্বাল মানেই নিরাপদ, এই ধারণাটাই সবচেয়ে বড় বিপদ। তিনি বলেন, “এই ধরনের সাপ্লিমেন্ট অনেক সময় ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার বাইরে থাকে। চোখ বন্ধ করে এগুলি গ্রহণ করা উচিত নয়। কিছু হার্ব অত্যন্ত ঘন, আবার কিছুতে ভারী ধাতু বা লেবেলে না থাকা উপাদান থাকতে পারে।”

লিভারের সমস্যা থাকলে যে হার্বগুলি এড়ানো জরুরি

রাজেশ্বরী শেট্টি কয়েকটি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন, যেগুলি লিভারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ
গ্রিন টি এক্সট্র্যাক্ট: সাধারণ চা নিরাপদ হলেও, ঘন এক্সট্র্যাক্ট লিভারের ক্ষতি করতে পারে
অশ্বগন্ধা: সাম্প্রতিককালে একাধিক লিভার ইনজুরির ঘটনার সঙ্গে যুক্ত
কাওয়া: বিশ্বজুড়ে গুরুতর লিভার টক্সিসিটির সঙ্গে সম্পর্কিত
অ্যালোভেরা চা: দীর্ঘদিন খেলে হেপাটাইটিসের ঝুঁকি
সেন্না: ওজন কমাতে ব্যবহৃত হলেও ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য নষ্ট করে
ক্যামোমাইল: অতিরিক্ত মাত্রায় লিভারের বিপাকক্রিয়া ব্যাহত করতে পারে

ট্রেন্ড নয়, চিকিৎসাই ভরসা

বিশেষজ্ঞদের মতে, লিভারের যত্ন কোনও ফ্যাশন ট্রেন্ডের বিষয় নয়। ডায়েট ও চিকিৎসকের পরামর্শেই লিভার সুস্থ রাখা সম্ভব।

রাজেশ্বরী র কথায়, “লিভার ঠিকমতো কাজ না করলে, যা একজন সুস্থ মানুষের জন্য উপকারী, সেটাই অসুস্থ মানুষের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।”