শরীর চালানোর প্রধান জ্বালানি হলো খাবার। আর প্রতিদিন তিনবেলা সুষম আহার করা সামগ্রিক সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। একটি ভাল খাদ্যাভ্যাস রক্তসঞ্চালন থেকে শুরু করে মাংসপেশির মেরামত পর্যন্ত সব কিছুকে সহায়তা করে। তবে আসল বিষয়টি হলো—শুধু কি খাচ্ছেন তা নয়, বরং খাওয়ার পর কি করছেন সেটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। খাওয়ার পর কিছু ভুল অভ্যাস হজমে অসুবিধা, পুষ্টি হ্রাস এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে।
আধুনিক জীবনযাত্রার কারণে অনেক অভ্যাস তৈরি হয়েছে, যা হজম প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়। ফলে গ্যাস, অম্বল, ফাঁপাভাব ও হজমজনিত সমস্যাগুলো এখন বেশ সাধারণ হয়ে উঠেছে। এসব সমস্যা এড়াতে চাইলে আপনার খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি খাওয়ার পরের রুটিনটিও ভালোভাবে লক্ষ্য করা দরকার।
কেন খাওয়ার পরের অভ্যাসগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কোন অভ্যাসগুলো এড়িয়ে চলা উচিত এবং ভাল হজমের জন্য কী কী অভ্যাস গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা জেনে নিন।

কেন খাওয়ার পরের অভ্যাস হজমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
খাওয়া শেষ করার পর শরীর খাবার ভেঙে পুষ্টি শোষণের কাজ শুরু করে। এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং কিছু অভ্যাস সহজেই এটিকে ব্যাহত করতে পারে। যেমন—খাওয়ার পর অতিরিক্ত জল খেলে হজমের জন্য প্রয়োজনীয় এনজাইম পাতলা হয়ে যায়, আবার সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়লে অ্যাসিড রিফ্লাক্সের সমস্যা হতে পারে। অন্য দিকে, সঠিক অভ্যাস শরীরকে হজমে সাহায্য করে, অস্বস্তি কমায় এবং পুষ্টি শোষণ বাড়ায়।

কোন কাজের আগে কতক্ষণ অপেক্ষা করবেন?
সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিচে সহজ একটি গাইড দেওয়া হল:

কাজ/অভ্যাস    কতক্ষণ অপেক্ষা করবেন
চা বা কফি       খাবারের অন্তত এর ঘণ্টা পরে
জল পান         খাওয়ার পর কয়েক চুমুক নেওয়া যেতে পারে, তবে এক গ্লাস জল খেতে হলে অন্তত ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন
ফল খাওয়া      খাবারের ৩০ মিনিট আগে বা দু’ঘণ্টা পরে
ব্যায়াম            হালকা হাঁটা ঠিক আছে, তবে ভারী ব্যায়াম খাবারের অন্তত ১ ঘণ্টা পরে করুন
ঘুমানো           খাওয়ার অন্তত দু’ঘণ্টা পরে

এই সহজ টাইমলাইন আপনার দৈনন্দিন রুটিনে যুক্ত করলে হজম অনেকটাই মসৃণ হবে এবং অম্বল, গ্যাস, ফাঁপাভাবের মতো সাধারণ সমস্যাগুলো কমে যাবে। সুস্থ হজম মানেই সুস্থ শরীর এবং প্রাণবন্ত জীবন।

খাবারের পর যে অভ্যাসগুলো ক্ষতিকর হতে পারে
১. খাবারের পরই চা বা কফি খাওয়া
অনেকেই কাজ বা পড়াশোনার সময় খাবারের পর চা–কফি খেতে পছন্দ করেন। কিন্তু এটি হজমের ক্ষতি করতে পারে। চায়ে থাকা ট্যানিন আয়রনের শোষণ কমিয়ে দেয়, আর চা ও কফি দুটোই অ্যাসিডিটি বাড়ায়। এর ফলে পেট ফোলা এবং হজমে সমস্যা দেখা দিতে পারে। নিরাপদ উপায় হল—খাওয়ার অন্তত এক ঘণ্টা পরে চা বা কফি পান করা।

২. খাওয়ার পর অতিরিক্ত জল পান
জল খাওয়া জরুরি হলেও সময় গুরুত্বপূর্ণ। খাওয়ার পর অনেক বেশি জল পান করলে পাকস্থলীর অ্যাসিড এবং হজম এনজাইম পাতলা হয়ে যায়, ফলে খাবার ভাঙতে দেরি হয়। এতে ভারী লাগার সমস্যা হতে পারে। কয়েক চুমুক জল খাওয়া ঠিক আছে, তবে পুরো এক গ্লাস জল খেতে চাইলে অন্তত ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন।

৩. খাওয়ার পরই ফল খাওয়া
ফল ভিটামিন, ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর হলেও খাবারের পরই খেলে পেটে ফারমেন্টেশন শুরু হয়। এতে গ্যাস ও ফোবাভাব তৈরি হয়। সঠিক সময় হল—খালি পেটে বা খাবারের ৩০ মিনিট আগে অথবা অন্তত দু’ঘণ্টা পরে।

৪. খাওয়ার পর ব্যায়াম করা
ব্যায়াম শরীরের জন্য ভাল, তবে খাবারের পরপরই ভারী ব্যায়াম করলে হজম প্রক্রিয়ায় চাপ পড়ে। এতে বিপাকক্রিয়া ধীর হয় এবং পেটে ব্যথা বা বমি ভাব হতে পারে। হালকা হাঁটা ঠিক আছে, তবে ভারী ব্যায়াম অন্তত এক ঘণ্টা পরে করুন।

৫. খাওয়ার পর শুয়ে পড়া বা ঘুমনো
খাওয়ার পরপর শুয়ে গেলে পাকস্থলীর অ্যাসিড সহজেই খাদ্যনালীতে চলে যেতে পারে, এতে অ্যাসিডিটি ও হার্টবার্ন হয়। তাই অন্তত ২ ঘণ্টা পরে শোয়া উচিত।

খাবার নিয়ে প্রচলিত কিছু ভ্রান্ত ধারণা

ঠান্ডা জল হজমে সাহায্য করে
আসলে ঠান্ডা জল হজম ধীর করে দেয়, কারণ এটি খাবারের চর্বি জমাট বাঁধায় এবং এনজাইমের কার্যকারিতা কমায়।

খাওয়ার পরপর হাঁটা হজম ত্বরান্বিত করে
হালকা হাঁটা ঠিক আছে, তবে তীব্র হাঁটা বা এক্সারসাইজ করলে হজম প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।

খাওয়ার পর শুয়ে থাকলে খাবার ঠিকভাবে বসে যায়
বরং এতে অ্যাসিড রিফ্লাক্স ও হজমের সমস্যা বাড়ে।

রাতের খাবারের ক্ষেত্রে নিয়মগুলি কি আলাদা হওয়া উচিত?
হ্যাঁ। রাতের খাবারের পর সাধারণত শরীর বিশ্রামে যায়, তাই এই সময় শুয়ে পড়া এড়ানো আরও জরুরি। দুপুরের খাবারের পর কিছুক্ষণ বসা বা হালকা হাঁটা সম্ভব হলেও, রাতে খাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়লে গ্যাস, ফোলাভাব ও অ্যাসিডিটি বেড়ে যায়। তাই—
রাতের খাবার হালকা রাখুন।
সম্ভব হলে আগে খান।
এবং ঘুমনোর আগে অন্তত দু’ঘণ্টা বিরতি দিন।