আজকাল ওয়েবডেস্ক: স্নান মানেই যেন এক সহজ স্বাভাবিক অভ্যাস। ছোটবেলা থেকেই আমরা শিখেছি কীভাবে নিজেকে পরিষ্কার রাখতে হয়। কিন্তু ২০১৯ সালে ইন্টারনেটে এক বিতর্ক—‘পা কি আলাদা করে ধোয়া দরকার?’—দেখিয়ে দিয়েছিল, স্নানের ধরন নিয়ে সবাই যে একই পথে হাঁটে, তা নয়। ঠিক সেই প্রসঙ্গেই সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের (GWU) একদল গবেষক তাঁদের নতুন এক পরীক্ষায় ‘ঠাকুমার উপদেশ’-এর বৈজ্ঞানিক সত্যতা খুঁজে বের করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক কিথ ক্র্যান্ডল জানিয়েছেন, ছোটবেলায় তাঁর ঠাকুমা সবসময় বলতেন—“কানপিছনে, আঙুলের ফাঁকে আর নাভির মধ্যে ভালো করে ঘষে ধুয়ে নাও।” এই প্রজন্মান্তর উপদেশই পরবর্তীতে তাঁদের গবেষণার ভিত্তি হয়, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘গ্র্যান্ডমাদার হাইপোথিসিস’।

গবেষকদের মতে, অধিকাংশ মানুষ শরীরের এই তিনটি অংশ—কানের  পিছন, আঙুলের ফাঁক, ও নাভি—নিয়মিত ধোয় না। ফলে সেখানে জমে থাকে তেল, ঘাম, মৃত চামড়া ও নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়া, যা শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় আলাদা ধরণের মাইক্রোব তৈরি করে।

গবেষণার জন্য তাঁরা ১২৯ জন ছাত্রছাত্রীর শরীর থেকে বিভিন্ন অংশের নমুনা সংগ্রহ করেন। দেখা যায়, হাত-পা’র মতো নিয়মিত ধোয়া অংশে জীবাণুর বৈচিত্র্য বেশি, যা স্বাস্থ্যকর ত্বকের ইঙ্গিত দেয়। বিপরীতে, যেসব অংশে জল-সাবান কম পৌঁছায়, সেখানে জীবাণুর একরকম প্রজাতিই বেড়ে ওঠে, যা ত্বকের ভারসাম্য নষ্ট করে একজিমা, অ্যাকনে-র মতো সমস্যা ডেকে আনতে পারে।

গবেষণাটি সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়েছে 'Frontiers in Microbiology' পত্রিকায়। যদিও গবেষকরা জানিয়েছেন, সীমিত নমুনার কারণে আরও বড় আকারে গবেষণা প্রয়োজন। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ও পারিবারিক চিকিৎসকদের সতর্কবার্তা: মিয়ামি-ভিত্তিক চিকিৎসক ড. লরা পার্ডি বলেন, “শরীরের প্রত্যেকটি অংশ পরিষ্কার রাখা জরুরি—বিশেষ করে যেসব অংশ সহজে ভুলে যাই, যেমন কানের  পিছন, আঙুলের ফাঁক ও নাভি।”

আরও পড়ুন: দীর্ঘদিন ব্যবহার না করে মাকড়সার জাল জমেছে 'ওইখানে'? জমে থাকা ঝুল আর বোঁটকা গন্ধ উধাও হবে নিমেষে, জেনে নিন দীপাবলির 'ক্লিনিং সিক্রেট'

তাঁর মতে, শরীর ধোয়া শুধু দুর্গন্ধ বা ধুলো সরায় না; বরং মৃত কোষ, ঘাম, তেল, এমনকি ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া থেকেও ত্বককে রক্ষা করে।
অন্যদিকে, মিসৌরির চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ড. স্টেসি টাল জানান, কানপিছনে তেল ও মৃত চামড়া জমে গেলে সেবোরিয়িক ডার্মাটাইটিস নামের এক প্রদাহজনিত রোগ হতে পারে, যা মূলত মাথার খুশকিরই একটি রূপ। এ ছাড়া ওই জায়গায় ঘাম জমে দুর্গন্ধ ও সংক্রমণও ঘটাতে পারে।

কানপিছনে পরিষ্কার রাখার সহজ উপায়: 
বিশেষ কোনো পদ্ধতি বা পণ্য প্রয়োজন নেই। নিয়মিত স্নানের সময় আঙুল বা তোয়ালে দিয়ে হালকা করে ঘষে ধুলেই যথেষ্ট। যাঁদের কানে পিয়ার্সিং আছে, তাঁদের আরও সতর্ক থাকতে হবে সংক্রমণ এড়াতে।

আঙুলের ফাঁকে জমে থাকা ঘাম ও জীবাণু:
পায়ের আঙুলের ফাঁকে তেল কম থাকায় সেখানে জমা হয় মৃত চামড়া ও ধুলো। ঘাম জমে থাকলে ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাসের বৃদ্ধি ঘটে, ফলে হতে পারে অ্যাথলিটস ফুট, অর্থাৎ চুলকানি, লালচে ফুসকুড়ি, চামড়া খসখসে হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। গুরুতর ক্ষেত্রে সেলুলাইটিস নামের সংক্রমণও ছড়াতে পারে।

আরেক  অঙ্গ হলো পিঠ। আমাদের শরীরের সবচেয়ে বড় অংশ হলেও, পিঠ পুরোপুরি পরিষ্কার করা বেশ কঠিন। কারণ অধিকাংশ মানুষের হাত সেখানে পৌঁছায় না।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, প্রতিদিন বা একদিন পরপর পা ধোওয়া উচিত, বিশেষ করে আঙুলের ফাঁকে। ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে নিয়ে পরিষ্কার মোজা পরা প্রয়োজন। 

নাভি—শরীরের ‘অদৃশ্য কোণ’: নাভি হল এমন এক জায়গা যেখানে অন্ধকার, আর্দ্রতা ও চামড়ার ভাঁজের কারণে সহজেই ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস জন্মায়। যদি নিয়মিত পরিষ্কার না করা হয়, সেখানে দুর্গন্ধ, স্ট্যাফ বা ইস্ট সংক্রমণ পর্যন্ত হতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সপ্তাহে অন্তত তিন থেকে চারবার নাভি ধোওয়া উচিত। আঙুলে সামান্য সাবান লাগিয়ে ভেতরটা আলতো করে পরিষ্কার করলেই যথেষ্ট। কেউ চাইলে তুলোর কটন বাড ব্যবহার করতে পারেন, তবে অতিরিক্ত ঘষা চলবে না—কারণ এতে ত্বকে ক্ষত তৈরি হতে পারে।

জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষণা মনে করিয়ে দেয়, স্বাস্থ্যবিধির অনেক নিয়মই পূর্ববর্তী প্রজন্মের অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে। ‘ঠাকুমার উপদেশ’ হয়তো শুধুই যত্নের ভাষা নয়, বরং তার পেছনে লুকিয়ে আছে আধুনিক বিজ্ঞানও।

বিশেষজ্ঞদের এক কথায় পরামর্শ—“শরীরের প্রতিটি কোণ পরিষ্কার রাখুন, কারণ যেখানে জল-সাবান পৌঁছায় না, সেখানেই জীবাণু বাসা বাঁধে।”