আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ অজান্তেই মুখ দিয়ে শ্বাস নেন — এমনটাই জানাচ্ছে সাম্প্রতিক গবেষণা। অনেকে এটিকে সাধারণ অভ্যাস বা ঘুমের সময়ের সমস্যা ভেবে এড়িয়ে যান, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়া (mouth breathing) আসলে এক ‘নীরব স্বাস্থ্য-সমস্যা’, যা দীর্ঘমেয়াদে ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানাটমি গবেষক অধ্যাপক অ্যাডাম টেলর জানিয়েছেন, “দীর্ঘদিন মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়ার ফলে হৃদরোগ, মুখের দুর্গন্ধ, ক্লান্তি সহ নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।” তিনি আরও বলেন, মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়া কেবল ঘুমের মান নষ্টই করে না, এটি শরীরে নানা রোগের ঝুঁকিও বাড়ায় — যেমন স্থূলতা, আর্থ্রাইটিস, ডিমেনশিয়া এবং কিছু প্রকার ক্যানসার।

কেন মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়া হয়?

ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডা. ড্যান বামগার্টের মতে, দুই ধরনের কারণে মানুষ মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়। প্রথমত, শারীরিক বা গঠনগত সমস্যা — যেমন নাকের বক্রতা (deviated septum), নাকের বাধা বা পলিপ। দ্বিতীয়ত, অভ্যাসজনিত কারণ — অর্থাৎ কোনও শারীরিক সমস্যা না থাকলেও অভ্যাসবশত মুখ খোলা রেখে শ্বাস নেওয়া। তিনি বলেন, “অনেকেই বুঝতে পারেন না যে তাঁরা মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছেন। দিনভর ক্লান্তি, ঘুমের অভাব, মুখের দুর্গন্ধ বা অতিরিক্ত তৃষ্ণা — এগুলি মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়ার সাধারণ লক্ষণ।”

বিশেষজ্ঞরা জানান, মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়ার ফলে মুখ শুকিয়ে যায় এবং মুখে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়। লন্ডনের দন্তবিশেষজ্ঞ ডা. ভিক্টোরিয়া স্যাম্পসন বলেন, “যখন কেউ নিয়মিত মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়, তখন মুখে লালার পরিমাণ কমে যায়। লালা মুখের অম্লত্ব নিয়ন্ত্রণ করে ও ব্যাকটেরিয়া দমন করে। এর অভাবে ক্ষতিকর জীবাণু বেড়ে যায়, যা মাড়ির প্রদাহ থেকে শুরু করে হৃদরোগ পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে।” চিকিৎসকদের মতে, মুখের ব্যাকটেরিয়া এবং হৃদরোগ, স্ট্রোক, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এমনকি কোলন ক্যানসারের মধ্যেও সম্পর্ক রয়েছে — যা নিয়ে গবেষণা ক্রমেই বাড়ছে।

নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়া কেন জরুরি? 

অধ্যাপক টেলর বলেন, “নাকের গঠন এমন যে এটি বাতাসকে ছেঁকে, আর্দ্র করে ও উষ্ণ করে ফুসফুসে পাঠায়। ফলে শ্বাস নেওয়া সহজ হয় এবং শরীরে চাপ কম পড়ে।” কিন্তু মুখ খোলা রেখে ঘুমালে জিহ্বা ও চোয়াল পিছনে সরে গিয়ে শ্বাসনালীর পথ আটকে দেয়। এতে নাক ডাকা, ঘন ঘন ঘুম ভাঙা ও অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয় — যা সময়ের সঙ্গে স্থূলতা ও নানা বিপদের কারণ হতে পারে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু সেলিব্রিটি যেমন ফুটবলার আর্লিং হালান্ড ও উপস্থাপিকা টেস ডালি মুখে টেপ লাগিয়ে ঘুমানোর (mouth taping) পদ্ধতির প্রচার করেছেন। তাঁরা দাবি করেন, এতে ঘুম ভালো হয় ও কর্মক্ষমতা বাড়ে।
তবে American Journal of Otolaryngology-এ প্রকাশিত ১৭৭টি গবেষণার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মুখে টেপ লাগানোর কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই যে এটি ঘুমের মান উন্নত করে বা নাক ডাকা কমায়।

অধ্যাপক টেলর সতর্ক করে বলেন, “মুখে টেপ লাগানো বিপজ্জনক হতে পারে। কেউ যদি জোর করে শ্বাস ছাড়ার চেষ্টা করেন, তবে শরীরে কার্বন ডাই-অক্সাইড জমে স্ট্রেস বাড়াতে পারে।”

‘ফাংশনাল ব্রিদিং কোচ’ ভিক্টোরিয়া উইলসনের মতে, মুখে টেপ নয়, বরং ‘অল্টারনেট নস্ট্রিল ব্রিদিং’ বা পর্যায়ক্রমিক নাসারন্ধ্র শ্বাস ব্যায়ামই সবচেয়ে কার্যকর। তিনি বলেন, “চেয়ারে বসে কাঁধ শিথিল করুন। ডান নাসারন্ধ্র আঙুল দিয়ে বন্ধ করে বাম দিক দিয়ে শ্বাস নিন ও ছাড়ুন। এবার উল্টো দিকটি করুন। দিনে দুইবার এই ব্যায়াম করলে দ্রুত ফল মিলবে।” উইলসনের দাবি, এই ব্যায়াম রক্তচাপ কমায় এবং মানসিক চাপ হ্রাস করে। এমনকি প্রাক্তন মার্কিন ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটনও প্রতিদিন এটি অনুশীলন করেন বলে জানিয়েছেন।

এছাড়া, নাক পরিষ্কার রাখতে স্যালাইন সলিউশন বা বিশেষ নাসাল স্প্রে ব্যবহার করাও উপকারী হতে পারে। তবে অধ্যাপক টেলরের পরামর্শ, “যাঁরা নিয়মিত মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছেন, তাঁদের উচিত প্রথমে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। কারণ, এটি কোনও অভ্যাসের সমস্যা নাও হতে পারে — পেছনে গঠনগত বা শারীরিক বাধাও থাকতে পারে।” মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়া শুধুই ঘুমের অসুবিধা নয়; এটি শরীরের নানা জটিল রোগের সূচনা ঘটাতে পারে। সময়মতো অভ্যাস সংশোধন ও চিকিৎসা নিলে এই নীরব বিপদ এড়ানো সম্ভব।