আজকাল ওয়েবডেস্ক: “ইতিহাসে খুব কমই এমন মুহূর্ত আসে, যখন আমরা পুরাতন থেকে নতুনের পথে পা বাড়াই।” — ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর এই বিখ্যাত উক্তিই উচ্চারণ করলেন নিউইয়র্কের নতুন মেয়র জোহরান মামদানি, বুধবার রাতে তাঁর বিজয় ভাষণে। নেহরুর ১৯৪৭ সালের ‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’ বা ‘নিয়তির সঙ্গে সাক্ষাৎ’ ভাষণের এই লাইনগুলো উদ্ধৃত করে মামদানি যেন ইঙ্গিত দিলেন, নিউইয়র্কেও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছে।
মামদানি বলেন, “যখন একটি যুগের অবসান ঘটে, তখন জাতির আত্মা নতুন ভাষা খুঁজে পায়। আজকের রাতও সেই রকম—আমরা পুরাতন থেকে নতুনের পথে পা রাখছি।” তাঁর এই কথাগুলি শেষ হতে না হতেই সভাস্থলে বেজে ওঠে বলিউডের জনপ্রিয় গান ধুম (২০০৪)-এর থিম মিউজিক। এরপর বাজতে থাকে জে-জেড এবং আলিশিয়া কিজের এম্পায়ার স্টেট অব মাইন্ড—যা নিউইয়র্ক শহরের এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে এক ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে।
দক্ষিণ এশীয় শিকড়, বলিউড ভাষায় প্রচার
মামদানি তাঁর প্রচারে বারবার ফিরেছেন বলিউড ও দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতির প্রতীকে। তাঁর মা প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ার এবং বাবা বিশিষ্ট আফ্রিকান-ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানী মাহমুদ মামদানি। হিন্দিতে রেকর্ড করা তাঁর একাধিক প্রচার বার্তা, জনপ্রিয় সিনেমার সংলাপ ব্যবহার, কিংবা হাস্যরসাত্মক পোস্ট—সবই তাঁকে নিউইয়র্কের অভিবাসী সমাজে বিশেষভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছে। নেহরুর উদ্ধৃতি ছিল সেই সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ের চূড়ান্ত প্রকাশ।
নেহরুর ভাষণের ঐতিহাসিক প্রতিধ্বনি
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতের কিছু আগে, নয়াদিল্লির গরমে ঝলসানো সংবিধানসভা কক্ষে নেহরু উচ্চারণ করেছিলেন সেই অনন্ত উক্তিগুলি— “বহু বছর আগে আমরা এক প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম। আজ সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের সময় এসেছে, সম্পূর্ণ না হলেও যথেষ্ট পরিমাণে।”
“যখন বিশ্ব ঘুমিয়ে থাকবে, তখন ভারত জেগে উঠবে জীবনের ও স্বাধীনতার আলোয়।”
নেহরুর ভাষণ ছিল শুধু স্বাধীনতার ঘোষণাই নয়, বরং দায়িত্ব ও পুনর্জন্মের অঙ্গীকার। তিনি বলেছিলেন, “ভারতের সেবা মানে কোটি কোটি দুর্ভোগ-পীড়িত মানুষের সেবা—দারিদ্র্য, অজ্ঞানতা ও অসাম্য দূর করার সেবা।” নেহরু আহ্বান করেছিলেন ঐক্যের—“ক্ষুদ্র ও বিধ্বংসী সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে এক মহৎ স্বাধীন ভারতের প্রাসাদ গড়ে তোলার”।
একটি যুগান্তরের মঞ্চ
সেই রাতের পরিবেশ ছিল বৈদ্যুতিক। টাইম ম্যাগাজিনের ভাষায়, সংবিধানসভা কক্ষ ছিল “ভারতের নতুন তেরঙা পতাকার কমলা, সাদা ও সবুজ রঙে উজ্জ্বল।” মধ্যরাতের ঘড়ির বারোটা বাজতেই শঙ্খধ্বনি শোনা যায়—“প্রভাতের বার্তা”। সদস্যরা দাঁড়িয়ে শপথ নেন—ভারত ও তার জনগণের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করার।
বাইরে তখন ছিল উৎসবের আমেজ। হিন্দু, মুসলমান, শিখ—সবাই মিলে উদ্যাপন করছিল স্বাধীনতা। আমেরিকান সাংবাদিকের ভাষায়, “এটা ছিল টাইমস স্কোয়ারের নববর্ষ উদ্যাপনের মতো।” কিন্তু সেই উল্লাসের মধ্যেই উপমহাদেশে শুরু হয়েছিল বিভাজনের রক্তক্ষয়ী অধ্যায়—যেখানে প্রায় ১৫ মিলিয়ন মানুষ স্থানচ্যুত হয় এবং প্রায় এক মিলিয়ন প্রাণ হারায়।
নেহেরুর ভাষণ যেন একটা যুগ পেরিয়ে অনুপ্রেরণা
ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ নেহরুর ভাষণকে বলেছেন “আবেগ ও বাগ্মিতায় সমৃদ্ধ”; শ্রীনাথ রাঘবনের মতে, “সেই ভাষণ আজও অনুরণিত হয়, কারণ তা মুহূর্তটিকে সত্যিকারের ধরতে পেরেছিল।” অস্ট্রেলিয়ান কূটনীতিক ও নেহরুর জীবনীকার ওয়াল্টার ক্রকারের মন্তব্য, “তাঁর বক্তৃতাগুলোর ব্যাপ্তি ও স্বতঃস্ফূর্ততা তুলনাহীন।” ভাষণের শেষে নেহরু বলেছিলেন, “আমাদের সামনে কঠিন পরিশ্রম অপেক্ষা করছে। যতদিন না আমাদের প্রতিশ্রুতি সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ হয়, ততদিন কোনো বিশ্রাম নেই।”
নিউইয়র্কে নতুন প্রতিশ্রুতি
আজ সাত দশক পরে, সেই নেহরুবাণী যেন প্রতিধ্বনিত হলো নিউইয়র্কে জোহরান মামদানির কণ্ঠে। নতুন প্রজন্মের এই তরুণ নেতা—ভারতীয় বংশোদ্ভূত, আফ্রিকান অভিজ্ঞতায় গড়া, আমেরিকান নাগরিক চেতনার প্রতিনিধি—নিজের শহরকে নতুন এক সামাজিক দায়িত্ব ও সমতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করলেন। যেভাবে ১৯৪৭-এ নেহরু বলেছিলেন “স্বাধীনতা কোনো বিশ্রামের নয়, এক অনবরত সংগ্রামের সূচনা,”—তেমনি মামদানির এই জয়ও এক নতুন সংগ্রামের প্রতীক। নিউইয়র্কের রাজনীতিতে, হয়তো এখান থেকেই শুরু হলো নতুন এক ‘নিয়তির সঙ্গে সাক্ষাৎ’।
