আজকাল ওয়েবডেস্ক:  আমরা সাধারণত স্কুলকে ভাবি বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার জায়গা হিসেবে। কিন্তু এক সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বাস্তবে অনেক তরুণ-তরুণী ব্যস্ত ক্লাসরুম ও করিডরের মাঝেই নিজেকে আবেগগতভাবে বিচ্ছিন্ন বোধ করে।


গবেষণার মতে, একাকীত্ব শুধু একা থাকার কারণে নয়, বরং ক্ষতিকর সামাজিক গতিশীলতার ফলেও তৈরি হয়। অর্থাৎ, পাশে অনেক সহপাঠী থাকা সত্ত্বেও যদি পরিবেশ নিরাপদ না মনে হয়, তাহলে সেই উপস্থিতি বরং একাকীত্বকে আরও গভীর করে তোলে।


ফ্লিন্ডারস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গবেষক বেন লোহমেয়ার বলেন, “প্রবীণদের মতো নয়, তরুণরা প্রায়ই বাধ্য হয়ে দীর্ঘ সময় কাটায় এমন মানুষের সঙ্গে, যাদের সঙ্গে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। তাই একাকীত্ব এখানে বিচ্ছিন্নতার চেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত।”


এটি প্রচলিত ধারণার বিপরীত। আমরা সাধারণত শিক্ষার্থীদের বলি – “বাইরে বেরোও, মিশে যাও।” কিন্তু যদি সেই ভিড়েই থাকে ঠাট্টা, বর্জন বা মর্যাদা নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা, তাহলে সমাধান কার্যকর হয় না। কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তাহীন পরিবেশ একাকীত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

আরও পড়ুন: শরীরে কোথায় চর্বি জমছে, তাতেই লুকিয়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি


এই গবেষণা দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ান ইউথ ফোরামের সহযোগিতায় পরিচালিত হয়েছে। তাই এতে উঠে এসেছে শিক্ষার্থীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা। তারা শুধু একবারের কটূক্তি নয়, বরং বারবার ঘটে চলা ধাঁচের ঘটনা—কে কোথায় বসবে, কে কথা বলবে, কাকে উপহাস করা হবে, কাকে উপেক্ষা করা হবে—এসব প্যাটার্ন বর্ণনা করেছে।


গবেষকরা সমাজবিজ্ঞানী পিয়ের বোর্দিয়ুর তত্ত্ব থেকে ধারণা নিয়ে এই প্রক্রিয়াকে বলেছেন “আবেগজনিত সহিংসতা” । অর্থাৎ, ক্ষতি শুধু ব্যক্তিগত বুলিং নয়, বরং স্কুলজীবনের সামাজিক কাঠামো, নিয়ম ও শ্রেণিবিন্যাস থেকেও আসে।


লোহমেয়ার বলেন, “আমাদের ফলাফল দেখায়, একাকীত্ব আর বুলিংকে কেবল ব্যক্তিগত সমস্যা হিসেবে দেখলে হবে না। এগুলো স্কুলব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত অসমতা ও আবেগগত ক্ষতির অংশ।”


এই দৃষ্টিভঙ্গি একটি প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে বুলিংকে ব্যক্তিগত আচরণ নয়, বরং সংস্কৃতি, নীতি ও ক্ষমতার কাঠামো দ্বারা গঠিত একটি প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। গবেষকরা মনে করেন, একাকীত্বকেও একইভাবে দেখা উচিত।


তাহলে প্রশ্ন হয়: কীভাবে স্কুলের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাকে এমনভাবে পুনর্গঠন করা যায়, যাতে শিক্ষার্থীরা ভিড়ের মাঝেই আর একা বোধ না করে? গবেষকরা কিছু বাস্তব পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন—
শান্ত কক্ষ বা “quiet rooms” রাখা, যেখানে শিক্ষার্থীরা চাপমুক্তভাবে থাকতে পারে।
তৃতীয় স্থান বা “third spaces”, যা হটস্পটের বাইরে বিকল্প পরিবেশ তৈরি করে।
অপ্ট-ইন জোন, যেখানে শিক্ষকরা সম্মান ও সহমর্মিতার পরিবেশ দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ জায়গা তৈরি করেন।
অস্ট্রেলিয়ার বিশেষ সহায়তা স্কুল ফর ইয়ুথ ইতিমধ্যেই এই ধরনের মডেল ব্যবহার করা হচ্ছে।


লোহমেয়ারের মতে, একাকীত্বকে সামাজিক সহিংসতার এক রূপ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতায় নতুনভাবে কাজ করা সম্ভব। এর ফলে শিক্ষক ও প্রশাসকরা নতুন ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি পাবেন—রুটিন বদলাতে, তদারকি পুনর্ভাবনা করতে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য নতুনভাবে গড়তে।


ছোট পরিবর্তন বড় প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন বিরতির সময় ভাগ করে দিলে সংঘর্ষ কমতে পারে। ভিন্ন বয়সের শিক্ষার্থীদের মেন্টরশিপে জড়ালে কঠোর স্তরবিন্যাস ভেঙে যেতে পারে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বদলে পুনরুদ্ধারমূলক পদ্ধতি ব্যবহার করলে আবেগগত নিরাপত্তা বাড়ে। গুরুত্বপূর্ণ হল প্রতিটি পদক্ষেপ একটাই প্রশ্ন তুলুক: দিনের শেষে যে শিক্ষার্থী তার জায়গা নিয়ে সবচেয়ে অনিশ্চিত, তার জন্য কি পরিবেশটা নিরাপদ হল?