আজকাল ওয়েবডেস্ক: ২০২৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, কাঠমান্ডুর রাস্তায় আগুন আর বিক্ষোভে উত্তাল পরিস্থিতি যখন চরমে পৌঁছয় তখন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়েন। হাজারো ক্ষুব্ধ তরুণ-তরুণী ও সাধারণ মানুষ তাঁর বাসভবনের দিকে অগ্রসর হলে আতঙ্কিত অলি সেনাবাহিনীর প্রধান অশোক রাজ সিগডেলকে ফোন করে রাজধানী থেকে হেলিকপ্টারে পালানোর অনুরোধ জানান। কিন্তু সেনাপ্রধানের জবাব ছিল কড়া—“পদত্যাগ করলে তবেই হেলিকপ্টার।”


২০২৪ সালে শের বাহাদুর দেউবা সরকারের পতনের পর ফের ক্ষমতায় আসা অলি এক বছরের মধ্যেই ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সম্পদ অপব্যবহার এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমতে থাকে। তবে চূড়ান্ত ধাক্কা আসে টানা কয়েক দিনের বিক্ষোভ থেকে, যেখানে নেতৃত্বে ছিল জেনারেশন-জেড যুবসমাজ।


৮ সেপ্টেম্বর নেপালের সরকার ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাপ নিষিদ্ধ করলে আন্দোলন রূপ নেয় সহিংসতায়। ওইদিনই সংঘর্ষে অন্তত ১৯ জন নিহত এবং ৩০০-র বেশি আহত হন। পরে মৃত্যুর সংখ্যা ৭২-এ পৌঁছায়। পরদিন ভোর থেকেই কারফিউ অমান্য করে হাজারো তরুণ-তরুণী আবারও রাস্তায় নেমে আসে।

আরও পড়ুন: ভারতের বাজারে আরও বাড়বে সোনার চাহিদা, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা


সকালে অলি পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করলেও বাড়তে থাকা বিক্ষোভকে তিনি তেমন গুরুত্ব দেননি। যখন পুলিশ প্রধান ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সতর্ক করেছিলেন যে নেতাদের বাড়ি ঘিরে ফেলা হচ্ছে, তখন অলি স্রেফ বলেন, “ঠিক আছে”, এবং বাড়তি নিরাপত্তা দিতে বলেন।
সেদিন দুপুরে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ডের বাড়ি ঘিরে ফেলা হয়। বিক্ষোভকারীরা একে একে মন্ত্রীর বাসভবন ও থানায় হামলা চালায়। সেনা ও সশস্ত্র পুলিশ বিশেষ সহায়তা না দেওয়ায় সাধারণ পুলিশ চাপে ভেঙে পড়ে।


ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের বৈঠকেও অলি পরিস্থিতিকে হালকা করে দেখেন। তিনি দাবি করেন, এটি শুধু “তরুণদের অস্থিরতা”, যেখানে কিছু মাওবাদী ও রাজতন্ত্রপন্থীরা ঢুকে পড়েছে। কিন্তু বাস্তবে গোয়েন্দা ব্যর্থতা ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে পরিস্থিতি হাতছাড়া হয়ে যায়।


অলির পতনের পেছনে প্রধান চালিকা শক্তি ছিল তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা তথাকথিত “নেপো বেবি” আন্দোলন। এতে শাসক পরিবারের সন্তানদের বিপুল সম্পদ ও বিলাসবহুল জীবনের ছবি ভাইরাল হয়। যখন দেশে যুব বেকারত্ব ২১ শতাংশ, তখন সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। “শুধু অনলাইনে বললেই হবে না, রাস্তায় নামতে হবে”—এই ডাকেই আন্দোলন ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। ব্যারিকেড গুঁড়িয়ে প্রতিবাদকারীরা সংসদ ভবনের দিকে অগ্রসর হয়। জলকামান, টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ কোনোটাই ভিড় ঠেকাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত সংসদ ভবন, সিংহ দরবারসহ বিভিন্ন নেতার বাড়ি পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা।


পুলিশের গুলিতে আরও হতাহতের পর যখন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেউবার বাসভবনে হামলা হয় এবং তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করতে হয়, তখন অলি পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। শেষ চেষ্টা হিসেবে সেনাপ্রধান সিগডেলকে ফোন করে তিনি হেলিকপ্টার চাইলেও জবাব আসে—“পদত্যাগের পরেই সম্ভব।” বাধ্য হয়ে অলি রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পাওডেলকে নিজের পদত্যাগপত্র পাঠান। যা শুরু হয়েছিল অনলাইনে ক্ষোভ থেকে, তা শেষমেশ নেপালের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে তীব্র যুব-আন্দোলনে রূপ নিল, আর তারই ধাক্কায় ক্ষমতা হারালেন কেপি শর্মা অলি।