আজকাল ওয়েবডেস্ক: বলিভিয়ায় সদ্য ক্ষমতায় আসা ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো পাজ তাঁর প্রশাসনের সূচনালগ্নেই দেশের অর্থনীতিতে বড়সড় রদবদল ঘটাতে গিয়ে তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছেন। ক্ষমতায় এসেই তিনি পূর্বতন ‘মুভমেন্ট টুয়ার্ডস সোশ্যালিজম’ (MAS)-নেতৃত্বাধীন পরিবর্তনের সরকারের একটি ঐতিহাসিক নীতি-জ্বালানি ভর্তুকি-সম্পূর্ণভাবে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। শ্রমিক সংগঠনগুলির অভিযোগ, এই ভর্তুকি দেশের দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষকে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে সহায়তা করত।

প্রেসিডেন্ট পাজ তাঁর এক্স অ্যাকাউন্টে এই সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে যুক্তি দিয়ে জানান, তিনি একটি “অর্থনৈতিক ও সামাজিক জরুরি অবস্থা” ঘোষণা করেছেন, যার উদ্দেশ্য হাইড্রোকার্বনের দাম বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। তাঁর ভাষায়, “এটি কঠিন কিন্তু অপরিহার্য সিদ্ধান্ত-জ্বালানির জোগান নিশ্চিত করতে এবং আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভের ক্ষয় বন্ধ করতেই এই পদক্ষেপ।” তিনি আরও দাবি করেন, জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি থেকে প্রাপ্ত অতিরিক্ত অর্থ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে আটকে থাকবে না, এর ৫০ শতাংশ সরাসরি অঞ্চল ও উপ-জাতীয় সরকারগুলিকে দেওয়া হবে, যাতে হাসপাতাল, স্কুল ও জনপরিষেবার উন্নয়ন সম্ভব হয়।

এই সিদ্ধান্তের পাল্টা হিসেবে সরকার ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা করেছে। পাজ জানিয়েছেন, ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩,৩০০ বলিভিয়ানোতে পৌঁছবে। পাশাপাশি প্রবীণ নাগরিকদের জন্য ‘রেন্তা দিগনিদাদ’ বা সম্মানভাতা বাড়িয়ে ৫০০ বলিভিয়ানো করা হবে।

পাজ সরকারের এই নীতিকে স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। এক বিবৃতিতে তারা জানায়, “যুক্তরাষ্ট্র, প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো পাজের ঘোষিত অর্থনৈতিক সংস্কার প্যাকেজকে স্বাগত জানায়, যা দশকের পর দশক ধরে চলা ব্যর্থ নীতির পর বলিভিয়ায় স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি ও বিনিয়োগ ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে।”

তবে সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দ্রুত সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে বলিভিয়ার শ্রমিক শ্রেণি। খনি শ্রমিক, কারখানা শ্রমিক, পরিবহণ কর্মী এবং কোকা চাষিদের সংগঠনগুলি একযোগে ডিক্রি ৫৫০৩ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আন্দোলনে নামে। তাদের বক্তব্য, এই ডিক্রি কার্যকর হলে দ্রব্যমূল্য আরও বাড়বে, যা ইতিমধ্যেই অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত দেশের সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে।

ডিসেম্বরের ২২ তারিখে হাজার হাজার শ্রমিক লা পাজ শহরের কেন্দ্রস্থল ভরিয়ে দেন। এই সমাবেশ ফের একবার প্রমাণ করে দেয় যে, বলিভিয়ার সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণির ঐতিহাসিক আন্দোলনক্ষমতা এখনও অটুট। এক ইউনিয়ন নেতা সমাবেশে বলেন, “এই ডিক্রির মাধ্যমে আমাদের দেশ, আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রি করে দেওয়ার পথ তৈরি করা হচ্ছে। এতে ধনীরা আরও ধনী হবে, আর গরিবরা আরও গরিব। আমরা এটা হতে দেব না।”

শুধু রাজধানী নয়, দেশের নয়টি বিভাগের মধ্যে ছয়টিতেই গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করা হয়েছে। এর ফলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, এই আন্দোলন জাতীয় স্তরে বিস্তৃত এবং বহু দশক ধরে বিভিন্ন সরকারের নব্য-উদারনৈতিক সংস্কারের বিরুদ্ধে যে শ্রমিক প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, তারই ধারাবাহিকতা এটি।

সোমবার বৃহত্তম সমাবেশের নেতৃত্ব দেয় বলিভিয়ার ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ মাইনিং কো-অপারেটিভস (ফেনকমিন)। এল আল্টো শহর থেকে লা পাজ পর্যন্ত দীর্ঘ পদযাত্রায় হাজার হাজার খনি শ্রমিক অংশ নেন। ফেনকমিনের নেতা আলফ্রেদো উনো জানান, জ্বালানি ভর্তুকি প্রত্যাহার হলে ছোট ও মাঝারি খনি সংস্থাগুলির উৎপাদন খরচ বিপুলভাবে বাড়বে, যার ফল হবে ব্যাপক বেকারত্ব ও শ্রমিকদের অনাহার।

একইসঙ্গে কোচাবাম্বায় কারখানা শ্রমিক সংগঠনগুলি ওরুরো ও লা পাজ সংযোগকারী একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পথ অবরোধ করে। স্বাধীন পরিবহণ ইউনিয়নগুলিও সরকারকে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারে বাধ্য করতে আন্দোলন জোরদার করার ঘোষণা দিয়েছে।

বলিভিয়ান ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন (COB) স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকার সংশ্লিষ্ট কোনও শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করেনি। সংগঠনের শীর্ষ নেতা মারিও আরগোলো বলেন, “এটি সম্পূর্ণ একতরফা সিদ্ধান্ত। আমরা পিছিয়ে যাব না, আমাদের মানুষদের বাদ দিয়ে কোনও আলোচনা করব না, এবং যে আস্থা নিয়ে আমাদের এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না।”

যদিও COB সরকার পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সম্মত হয়েছে এবং প্রথম বৈঠকটি ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়, তবুও তারা জানিয়েছে ডিক্রি ৫৫০৩ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত লা পাজ ও অন্যান্য অঞ্চলে আন্দোলন চলবে। ফেনকমিনও আলোচনায় যোগ দিয়ে অভিযোগ করেছে, সরকারের এই পদক্ষেপ কৌশলগত প্রাকৃতিক সম্পদ বেসরকারি খাতে হস্তান্তরের পথ খুলে দিচ্ছে, যা সরাসরি সংবিধান ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী।

ডানপন্থী সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কার বনাম বলিভিয়ার শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলন- এই সংঘাত কোন দিকে মোড় নেয়, তা এখন গোটা লাতিন আমেরিকা গভীর নজরে দেখছে।