আজকাল ওয়েবডেস্ক: জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংস্থা (UN Climate Change) জানিয়েছে, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) বিস্তারিত জলবায়ু পরিকল্পনা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জমা না পড়ায় তাদের ২০৩৫ সালের জাতীয় লক্ষ্যগুলোর মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ ঘাটতি রয়ে গেছে। ফলে, সংস্থার এই বছরের প্রতিবেদন কেবল একটি “আংশিক চিত্র” দিতে পেরেছে।
তবে সংস্থা তাদের মূল প্রতিবেদনের সঙ্গে একটি আনুমানিক হিসাব যুক্ত করেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে — ইতিহাসে প্রথমবার বিশ্বের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ক্রমহ্রাসমান গতিপথে রয়েছে। কিন্তু সেই গতি এখনো ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে উষ্ণতা সীমিত রাখার মতো যথেষ্ট নয়। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি সতর্ক করে বলেন, “দেশগুলির ধীর পদক্ষেপের কারণে এখন প্রায় অবশ্যম্ভাবী যে স্বল্পমেয়াদে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করবেই মানবজাতি।” তাঁর মতে, এর ফলে ভয়াবহ প্রভাব দেখা দেবে—যতদিন না দেশগুলো পুনরায় তাপমাত্রা কমিয়ে আনার পথে সফল হয়।
জাতিসংঘের আন্তঃসরকারি জলবায়ু প্যানেল (IPCC) জানিয়েছে, বিশ্ব উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখতে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্ব নিঃসরণ কমাতে হবে অন্তত ৬০%। জাতিসংঘের জলবায়ু প্রধান সাইমন স্টিয়েল এক বিবৃতিতে বলেন, “বিজ্ঞান যেমন স্পষ্টভাবে বলছে যে উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রির বেশি যাওয়া ঠেকাতে হবে, তেমনি এটাও স্পষ্ট—যদি সাময়িকভাবে সীমা অতিক্রম হয়, তবে যত দ্রুত সম্ভব আবার সেই সীমায় ফিরে আসতে হবে। এর জন্য প্রতিটি খাতে দ্রুততর পদক্ষেপ প্রয়োজন।”
১১ নভেম্বর থেকে অ্যামাজনে শুরু হতে চলা দুই সপ্তাহব্যাপী COP30 জলবায়ু সম্মেলনের মুখ্য কাজ হবে এই স্থবির গতিকে ভেঙে নতুন উদ্যমে দেশগুলিকে এগিয়ে আনা। কিন্তু সম্মেলন শুরু হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের শীতল মনোভাব বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ইতিবাচক দিক হলো — পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে বিশেষ করে চীনের দ্রুত অগ্রগতি, যা গত বছর COP28-এ দেশগুলির দেওয়া “ফসিল জ্বালানি থেকে দূরে সরে যাওয়ার” প্রতিশ্রুতিকে নতুন গতি দিয়েছে।
ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলির জোট (AOSIS) জানিয়েছে, বড় অর্থনীতি ও সম্পদসম্পন্ন দেশগুলির পক্ষ থেকে লক্ষ্য হওয়া এই সমীক্ষায় “ভয়াবহ গাফিলতি” উদ্বেগজনক। তাদের বক্তব্য, “যারা এই সংকট সৃষ্টি করেনি, সেই উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপরই সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ছে। এই ধীর অগ্রগতি প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা উচিত।”
২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, শিল্প-পূর্ব যুগের (১৮৫০–১৯০০) তুলনায় বিশ্ব উষ্ণায়নকে ২ ডিগ্রির নিচে, এবং সম্ভব হলে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে। কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই প্রায় ১.৪ ডিগ্রি বেড়ে গেছে। বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করছেন, এই দশক শেষ হওয়ার আগেই ১.৫ ডিগ্রির সীমা অতিক্রম করা প্রায় নিশ্চিত। তাপমাত্রা যদি এই সীমা ছাড়িয়ে যায়, তবে পুনরায় তা নামিয়ে আনতে হবে — এমন প্রযুক্তির মাধ্যমে যা এখনো ব্যাপকভাবে কার্যকর হয়নি, যেমন বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা।
চুক্তি অনুযায়ী, দেশগুলো প্রতি পাঁচ বছরে একবার করে “Nationally Determined Contributions (NDCs)” নামে নতুন জলবায়ু লক্ষ্য জমা দেওয়ার কথা। এ বছর ২০৩৫ পর্যন্ত পরিকল্পনা জমা দেওয়ার সময়সীমা ছিল সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত। কিন্তু জাতিসংঘ জানিয়েছে, প্রায় ২০০ সদস্য দেশের মধ্যে মাত্র ৬৪টি দেশ সময়মতো পরিকল্পনা জমা দিয়েছে। ফলে, প্রতিবেদনে সামগ্রিক চিত্র অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। সাইমন স্টিয়েল বলেন, “এই দলিল একটি সীমিত ধারণা দিচ্ছে, তাই আমাদের একটি সামগ্রিক অনুমান করতে হয়েছে—যেখানে ২০৩৫ সালের মধ্যে নির্গমন প্রায় ১০% হ্রাসের সম্ভাবনা ধরা হয়েছে।”
জাতিসংঘের হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে চীনের নতুন অঙ্গীকার — ২০৩৫ সালের মধ্যে নির্গমন ৭–১০% কমানো, যা তাদের প্রথম পূর্ণাঙ্গ জাতীয় লক্ষ্য। ইউরোপীয় ইউনিয়নও সেপ্টেম্বরে জানায় যে তারা ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০৩৫ সালের মধ্যে ৬৬.২৫% থেকে ৭২.৫% পর্যন্ত নির্গমন হ্রাসের ইচ্ছা প্রকাশ করছে। তবে এটি এখনো “ইচ্ছাপত্র” হিসেবে জমা দেওয়া হয়নি, কারণ ২৭টি সদস্য দেশের মধ্যে মতবিরোধ রয়ে গেছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অনুমানটি প্রাক্তন প্রশাসনের জমা দেওয়া পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প জানুয়ারিতে ক্ষমতায় ফিরে আবারও প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে “প্রতারণা” বলে অভিহিত করেছেন।
বিশ্বজুড়ে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ সত্ত্বেও জাতিসংঘের মূল্যায়ন স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে যে বিশ্ব জলবায়ু পদক্ষেপ এখনো অনেক পিছিয়ে। সাইমন স্টিয়েল শেষ পর্যন্ত সতর্ক করে বলেন, “আমরা এখনো দৌড়ে আছি, কিন্তু আজকের আটশো কোটি মানুষের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী রক্ষা করতে হলে, COP30 থেকেই আমাদের গতি বাড়াতে হবে — এবং প্রতিটি বছর, প্রতিটি পদক্ষেপে।”
