আজকাল ওয়েবডেস্ক: মানুষ ছাড়া পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্ব কীভাবে চলতে পারে—এই ভাবনাটি কল্পনা করাই কঠিন। যদিও মানবজাতির ইতিহাস পৃথিবীর তুলনায় খুবই স্বল্প সময়ের, তবু এই অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা গ্রহটিকে অসংখ্যভাবে বদলে দিয়েছি। স্থলভাগ থেকে সমুদ্র—প্রায় সর্বত্রই রয়ে গেছে আমাদের “মানবিক ছাপ”। বন, নদী, মহাসাগর এমনকি বায়ুমণ্ডলও মানুষের কর্মকাণ্ডের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে।


তবু পৃথিবীর দীর্ঘ ইতিহাস আমাদের শেখায় যে কোনও প্রজাতিই চিরস্থায়ী নয়। এই বাস্তবতা যেমন কিছুটা অস্বস্তিকর, তেমনই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কৌতূহলও জাগায়—মানুষ না থাকলে পৃথিবীর হাল ধরবে কে?


হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ পৃথিবীর পরিবেশগত পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে। আমাদের আবিষ্কার, শহর, কৃষি ও শিল্পপ্রক্রিয়া প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে আমূল রূপান্তরিত করেছে। কিন্তু অনেক গবেষকের মতে, মানুষ একদিন পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেলে প্রকৃতি আবার নিজেকে মানিয়ে নেবে। তখনই প্রশ্ন উঠছে—আমাদের জায়গা কে বা কী নেবে?


মানুষহীন পৃথিবী: বিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গি
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টিম কুলসন, যিনি জীববিজ্ঞান ও বিবর্তন নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন, মনে করেন মানুষের বিলুপ্তি পৃথিবীর জন্য নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিতে পারে। তাঁর বই The Universal History of Us-এ তিনি জীবনের সম্পূর্ণ ইতিহাস বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এক চমকপ্রদ অনুমান তুলে ধরেছেন।


কুলসনের মতে, বিবর্তন হল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। তিনি বলেন, “বেশিরভাগ মিউটেশন ক্ষতিকর হলেও, কিছু মিউটেশন জীবনের জন্য উপকারী হয়ে ওঠে।” যেহেতু জিন উত্তরাধিকারসূত্রে বহন হয়, তাই এই উপকারী পরিবর্তনগুলি প্রজন্মের পর প্রজন্মে আরও বিস্তার লাভ করে।


তবে তিনি মনে করিয়ে দেন, “বিলুপ্তি সব প্রজাতিরই ভবিষ্যৎ—মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়, যদিও আশা করি সেটা অনেক দূরের ঘটনা।” এই বক্তব্য যেমন চিন্তা জাগায়, তেমনই জীবনের সাময়িকতার কথাও মনে করিয়ে দেয়।


মানুষের পরে কারা?
মানুষ ও তার নিকটাত্মীয় বৃহৎ বনমানুষরা যদি একদিন হারিয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রে তৈরি হবে শূন্যস্থান। কুলসনের মতে, এই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের প্রাণী। তিনি বলেন, ভবিষ্যতের কোনও প্রজাতি মানুষকে অনুকরণ করবে—এমন নয়। বরং “বুদ্ধিমত্তা ও জটিলতার নতুন রূপ অপ্রত্যাশিতভাবে উদ্ভব হতে পারে।”


অনেকে মনে করেন, মানুষের পরে প্রাইমেটরাই শীর্ষস্থান দখল করতে পারে। কিন্তু কুলসন এতে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, প্রাইমেটরা অত্যন্ত সামাজিক নির্ভরশীল—শিকার, পরিচর্যা ও পারস্পরিক সুরক্ষার উপর তাদের অস্তিত্ব দাঁড়িয়ে। পরিবেশে বড় ধরনের পরিবর্তন এলে এই সামাজিক কাঠামো টিকে থাকা কঠিন হতে পারে।


বিস্ময়কর উত্তরসূরি: অক্টোপাস
প্রাইমেটদের বদলে কুলসন যে প্রজাতির কথা বলেন, তা অনেককেই অবাক করতে পারে—অক্টোপাস। তাদের বুদ্ধিমত্তা, মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এবং জটিল সমস্যা সমাধানের দক্ষতা তাঁকে মুগ্ধ করেছে।


তিনি জানান, “রঙের ঝলকের মাধ্যমে যোগাযোগ, বস্তু নিয়ন্ত্রণ এবং জটিল সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা দেখায় যে উপযুক্ত পরিবেশ পেলে অক্টোপাসরা একদিন সভ্যতা-নির্মাতা প্রজাতিতে রূপান্তরিত হতে পারে।” তাদের স্নায়ুতন্ত্র বিকেন্দ্রীভূত, চিন্তাশক্তি উন্নত এবং আচরণ অত্যন্ত নমনীয়—যা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য উপযোগী।


অক্টোপাসরা ইতিমধ্যেই কৌতূহলী ও সৃজনশীল প্রাণী হিসেবে পরিচিত। কুলসনের ভাষায়, “কিছু অক্টোপাস গবেষণাগারের ট্যাঙ্ক থেকে রাতে পালিয়ে পাশের ট্যাঙ্কে ঢুকে পড়ে—বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু সত্য।” তারা সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারে, বয়াম খুলতে পারে, এমনকি কৌতূহলের স্পষ্ট লক্ষণও দেখায়।


মানুষ ছাড়া পৃথিবীর ভবিষ্যৎ যেমন অজানা, তেমনই সম্ভাবনাময়। হয়তো আমাদের অনুপস্থিতিতে জীবন নতুন আকারে, নতুন বুদ্ধিমত্তায় আবারও পৃথিবীকে চমকে দেবে।