আজকাল ওয়েবডেস্ক: সুইজারল্যান্ডের এক বিশেষ গবেষণাগারে জমা হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের জমাটবাঁধা মল! শুনতে যতই অদ্ভুত লাগুক, বিষয়টি কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান ও ভবিষ্যতের চিকিৎসা ব্যবস্থার দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই উদ্যোগটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘মাইক্রোবায়োটা ভল্ট’ (Microbiota Vault) — যা নরওয়ের বিখ্যাত Svalbard Global Seed Vault-এর আদলে তৈরি। যেভাবে নরওয়ে বিশ্বের নানা দেশের বীজ সংরক্ষণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে, ঠিক সেভাবেই সুইজারল্যান্ডের এই ভল্ট ভবিষ্যতের মানবস্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে।
এই ভল্টে ইতিমধ্যে সংরক্ষিত হয়েছে ১,২০০টিরও বেশি মানুষের মল নমুনা, যেগুলি রাখা হয়েছে মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। গবেষকদের লক্ষ্য, ২০২৯ সালের মধ্যে অন্তত ১০,০০০টি নমুনা সংগ্রহ করা। শুধু মানুষের মলই নয়, এই ভল্টে সংরক্ষিত রয়েছে প্রায় ২০০ ধরনের ফার্মেন্টেড বা পচনক্রিয়াজনিত খাদ্যও, যেগুলি নানা রকম উপকারী জীবাণুতে ভরপুর। এই খাদ্যগুলি অন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক, এবং ভবিষ্যতে মাইক্রোব সংরক্ষণের গবেষণায় দিকনির্দেশ দিতে পারে।
মানুষের মলে কোটি কোটি জীবাণু বা মাইক্রোব বাস করে, যেগুলি আমাদের শরীরের হজম, রোগপ্রতিরোধ, এমনকি মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন যে আধুনিক জীবনযাত্রা, শিল্পোন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং খাদ্যাভ্যাসের একঘেয়েমি এই মাইক্রোব বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করছে। এর ফলেই বাড়ছে নানা দীর্ঘস্থায়ী রোগ, যেমন অটোইমিউন ডিজঅর্ডার, মেটাবলিক সিনড্রোম ও হজমজনিত অসুখ।
এই কারণেই ভবিষ্যতের জন্য এই জীবাণুদের এক “ব্যাকআপ কপি” সংরক্ষণ করার ভাবনা নিয়েছেন গবেষকরা। তাদের বিশ্বাস, একদিন এই সংরক্ষিত মাইক্রোবগুলোই হয়তো নতুন ধরনের চিকিৎসা উদ্ভাবন, রোগনিরাময় বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবেশ পুনর্গঠনের কাজে ব্যবহার করা যাবে। রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড মেডিসিনের পরিচালক ও গবেষক ড. মার্টিন ব্লেসার বলেছেন, “মানব ক্রিয়াকলাপ আমাদের নিজস্ব মাইক্রোবায়োমকে ধ্বংস করছে, এবং এর প্রমাণ ক্রমশ বাড়ছে।”
আরও পড়ুন: চার্চ অফ ইংল্যান্ডের ৫০০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার, মহিলা আর্চবিশপ হতে চলেছেনে সারা মুলালি, কে তিনি?
সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা এই প্রকল্পটি বর্তমানে তার “গ্রোথ স্টেজ”-এ পৌঁছেছে। গত সাত বছরে বিজ্ঞানীরা বেনিন, ব্রাজিল, ইথিওপিয়া, ঘানা, লাওস, থাইল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ড থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এখন তারা পৃথিবীর নানা নাজুক ইকোসিস্টেম থেকেও জীবাণু সংগ্রহের পরিকল্পনা করছেন। ভবিষ্যতে এই ভল্টের একটি স্থায়ী আবাস গড়ে তোলা হবে এমন কোনও শীতপ্রধান দেশে—যেমন সুইজারল্যান্ড বা কানাডা।
তবে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, এখনই নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় যে এইভাবে সংরক্ষিত জীবাণুগুলি ভবিষ্যতে সম্পূর্ণভাবে পুনর্জীবিত করা যাবে কি না। কিন্তু প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এমন সম্ভাবনা বাড়বে বলেই তারা বিশ্বাস করেন। ড. ব্লেসার আশাবাদী মন্তব্য করেছেন, “হয়তো একশো বছর পর এই সংরক্ষিত মাইক্রোবগুলোই আমাদের কোনও বড় বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে।”
গবেষক দলের বক্তব্য, “যেমন আমরা বীজ সংরক্ষণ করি ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য, তেমনি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব এই ক্ষুদ্র জীববৈচিত্র্যও রক্ষা করা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা আমাদের কর্তব্য।”
এই ধরনের উদ্যোগ অবশ্য একেবারে নতুন নয়। গত বছরই যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেকনোলজি (NIST)-এর বিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে সংরক্ষিত মানব মলের নমুনা পেয়েছিলেন। সেগুলি থেকে তৈরি করা হয়েছিল গুঁড়ো পদার্থ, যা পরে তরলে মিশিয়ে ‘স্মুদি’-এর মতো ঘন মিশ্রণ তৈরি করে ১০,০০০ টিউবে ভাগ করে সংরক্ষণ করা হয়। এই গবেষণা ভবিষ্যতের চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত খুলতে সাহায্য করছে—যেখানে মানুষের মল থেকেই তৈরি হতে পারে রোগপ্রতিরোধক বা নতুন ধরণের ওষুধ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা শুধু বাঘ-হাতি বা গাছপালার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়—আমাদের শরীরের অদৃশ্য জীবাণুগুলিও সেই বৈচিত্র্যের অংশ। তাই সুইজারল্যান্ডের এই “ডুমসডে মল ভল্ট” হয়তো একদিন মানব সভ্যতার এক অভাবনীয় ত্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠবে।
