আজকাল ওয়েবডেস্ক: সৌদি আরব সরকার অবশেষে কয়েক দশক ধরে চলা বিতর্কিত ‘কাফালা সিস্টেম’ (Kafala System) বাতিল করার ঘোষণা করেছে। এই সিদ্ধান্তে উপকৃত হবেন লক্ষ লক্ষ অভিবাসী শ্রমিক, বিশেষত ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল ও ফিলিপাইন-সহ দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমিকরা, যারা এতদিন এই ব্যবস্থার আওতায় নানা শোষণ ও সীমাবদ্ধতার শিকার ছিলেন।
কী ছিল কাফালা ব্যবস্থা?
কাফালা বা স্পনসরশিপ ব্যবস্থা অনুযায়ী, বিদেশি শ্রমিকদের কাজ, বাসস্থান এবং এমনকি দেশ ত্যাগের অনুমতিও নির্ভর করত তাঁদের স্থানীয় নিয়োগকর্তা বা স্পনসরের অনুমতির উপর। ফলে শ্রমিকরা কার্যত তাঁদের নিয়োগকর্তার করুণার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তেন। নিয়োগকর্তার অনুমতি ছাড়া চাকরি পরিবর্তন, দেশে ফেরা বা এমনকি অন্যত্র যাওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। এই ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মহলে অনেকেই “আধুনিক দাসপ্রথা” বলে অভিহিত করেছেন।
বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন এই কাফালা ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করেছে। কারণ, এতে নিয়োগকর্তাদের হাতে শ্রমিকদের উপর প্রায় পূর্ণ ক্ষমতা চলে যেত। অনেক সময় শ্রমিকদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হত, বেতন আটকে রাখা হত, এবং অত্যন্ত শোষণমূলক পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা হত। বিশেষত ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপের আগে বিশ্বজুড়ে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বাড়ে, কারণ সেই সময় হাজার হাজার দক্ষিণ এশীয় শ্রমিক নির্মাণক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মারা যান।
নতুন ব্যবস্থায় শ্রমিকদের অধিক স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে তারা চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে নিয়োগকর্তার অনুমতি ছাড়াই চাকরি পরিবর্তন করতে পারবেন। এছাড়া তারা দেশের বাইরে যাতায়াত বা স্থায়ীভাবে ফিরে যাওয়ার জন্যও শুধুমাত্র ইলেকট্রনিকভাবে নিয়োগকর্তাকে জানিয়ে অনুমতি নিতে পারবেন, কোনও লিখিত বা ব্যক্তিগত সম্মতির প্রয়োজন হবে না।
এই সংস্কারের মাধ্যমে শ্রমিকদের কর্মস্থল বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা, চলাচলের অধিকার এবং ব্যক্তিগত মর্যাদা রক্ষা হবে বলে মনে করছে সৌদি প্রশাসন। সৌদি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই সংস্কার তাঁদের ‘ভিশন ২০৩০’ এবং ‘ন্যাশনাল ট্রান্সফরমেশন প্রোগ্রাম’-এর অংশ। এর লক্ষ্য হলো শ্রমবাজারকে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগবান্ধব করে তোলা। সরকার আশা করছে, এই পদক্ষেপের ফলে বিদেশি শ্রমিকদের মধ্যে আস্থা বাড়বে এবং সৌদি শ্রমবাজার আরও প্রতিযোগিতামূলক হবে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এই পরিবর্তনের ফলে ১০ লক্ষেরও বেশি অভিবাসী শ্রমিক সরাসরি উপকৃত হবেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ ভারতীয় শ্রমিক, যারা নির্মাণ, গৃহস্থালি কাজ ও পরিষেবা খাতে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, বাহরিন ২০০৯ সালে প্রথম কাফালা ব্যবস্থা বাতিল করেছিল। এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাত ২০১৫ সালে এই ব্যবস্থা আংশিকভাবে সংশোধন করে, যার ফলে শ্রমিকরা চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ছয় মাসের ‘জব সিকার ভিসা’-তে নতুন কাজ খুঁজতে পারেন। তবে এখনো পর্যন্ত কুয়েত, কাতার ও ওমানের মতো উপসাগরীয় দেশগুলোতে কঠোর কাফালা ব্যবস্থা বহাল রয়েছে।
সৌদি আরবে কাফালা ব্যবস্থার অবসান নিঃসন্দেহে উপসাগরীয় অঞ্চলে শ্রম অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। বিশেষ করে ভারতীয় অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য এটি এক নতুন আশার দিগন্ত খুলে দেবে — যেখানে তাঁদের শ্রম আর পরাধীনতার প্রতীক নয়, বরং মর্যাদার প্রতিফলন হবে।
