আজকাল ওয়েবডেস্ক: ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের উপকূলে শক্তিশালী ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে ফের কেঁপে উঠল আচেহ প্রদেশ। বুধবার সকালে হওয়া এই কম্পনের উৎস ছিল সিনাবাং থেকে প্রায় ৬৩ কিলোমিটার পশ্চিমে, ভূ-পৃষ্ঠের মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে। অগভীর হওয়ায় কম্পন তীব্র অনুভূত হয়, মুহূর্তে আতঙ্ক ছড়ায় স্থানীয়দের মধ্যে। তবে এখনো পর্যন্ত বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
এই ভূমিকম্প এমন এক সময় আঘাত হানে যখন দেশটি ঘূর্ণিঝড় সেনিয়ার তাণ্ডবে বিপর্যস্ত। উত্তর সুমাত্রা জুড়ে প্রবল বৃষ্টি ও পাহাড়ধসের কারণে ইতিমধ্যেই ২৫ জনের বেশি প্রাণহানি হয়েছে, নিখোঁজ রয়েছেন আরও কমপক্ষে ১০ জন। ঘরছাড়া হয়েছে হাজারো মানুষ; বহু এলাকা এখনো বিচ্ছিন্ন।
৩০ দিনে ১,৪৪০টি ভূমিকম্প
ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে ভূকম্পনপ্রবণ অঞ্চলের একটি। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (USGS) এবং ভলকানো ডিসকভারি জানিয়েছে—গত ৩০ দিনে দেশটিতে ১,৪৪০টির বেশি ভূমিকম্প নথিভুক্ত হয়েছে, যেগুলোর মাত্রা ছিল ৬.৪ পর্যন্ত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কম্পন (৪.৫ মাত্রার বেশি) প্রায় ২৫০টি, যা গত ছয় মাসে নথিভুক্ত ২,৩০০টির বেশি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের ধারাবাহিকতার মধ্যেই পড়ে।
‘রিং অব ফায়ার’-এর বিপদে ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরের কুখ্যাত "রিং অব ফায়ার"–এ অবস্থিত, যেখানে বিশ্বের প্রায় ৯০% ভূমিকম্প ঘটে। এখানে ১৫টি প্রধান টেকটোনিক প্লেট একে অপরের সঙ্গে নিরন্তর সংঘর্ষ, সাবডাকশন বা সরে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্ত। সুমাত্রা অঞ্চলটি বিশেষভাবে বিপজ্জনক, কারণ এটি সুন্দরা মেগাথ্রাস্ট নামের বিশাল সাবডাকশন জোনের উপর অবস্থিত—যেখানে ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেট প্রতি বছর ৫–৭ সেন্টিমিটার করে ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে। এই চলাচলেই জমে থাকা শক্তি মাঝেমধ্যেই ভূমিকম্পের আকারে বেরিয়ে আসে।
অগভীর ভূমিকম্প হওয়ায় ভূমির নড়াচড়া বেশি হয় এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় দ্রুত ক্ষতির সম্ভাবনা বাড়ে। যদিও এদিনের কম্পন সুনামির ঝুঁকি তৈরি করেনি, তবুও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে সুমাত্রার মতো অঞ্চলে যেকোনো সময় সাগর-তলদেশে শক্তিশালী কম্পন হলে সুনামি সৃষ্টি হতে পারে—যেমনটি ঘটেছিল ২০০৪ সালের ৯.১ মাত্রার মারাত্মক ভূমিকম্পে, যেখানে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় ২.৩ লক্ষ মানুষ।
এর আগেও সুমাত্রা এলাকায় ৬.৬ মাত্রার একাধিক কম্পন রেকর্ড হয়েছে, যা অঞ্চলটির প্লেট বাউন্ডারি স্ট্রেন এবং স্থানীয় ফাটল যেমন গ্রেট সুমাত্রা ফল্ট–এর সক্রিয়তার প্রমাণ বহন করে। নভেম্বর জুড়ে বারংবার কম্পন অনুভূত হওয়ায় জনগণ ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।
একই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় সেনিয়ারের দাপটে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। সিবোলগা এবং সেন্ট্রাল তাপানুলিতে সড়ক অবরুদ্ধ, বহু বাড়িঘর জলমগ্ন, অন্তত ৮,০০০ মানুষকে সরিয়ে নিরাপদ স্থানে রাখতে হয়েছে। আচেহ এবং রিয়াউতে আরও বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া দফতর, যা বাড়িয়ে দিতে পারে বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকি।
ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা (BNPB) জানিয়েছে, পরবর্তী কয়েকদিন আফটারশক অনুভূত হতে পারে। তারা হেলিকপ্টার ও উদ্ধারকর্মী মোতায়েন করেছে দুর্গত এলাকায় খাদ্য, ওষুধ এবং জরুরি সামগ্রী পৌঁছে দিতে। ভূমিকম্প ও জলবায়ু-সম্পর্কিত দুর্যোগের দ্বৈত চাপে পড়ে দেশটি আবারও প্রমাণ করেছে—প্রশান্ত রিং অব ফায়ার অঞ্চলে বসবাস মানেই অবিরাম প্রস্তুত থাকার প্রয়োজনীয়তা।
