আজকাল ওয়েবডেস্ক: পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের অবস্থান নিয়ে জোর গুঞ্জন ছড়াচ্ছে। কেউ বলছে তিনি অসুস্থ, কেউ বা মিথ্যা সংবাদ ছড়াচ্ছে যে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন—যা পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বারবার অস্বীকার করেছে। রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা জেল এবং দেশজুড়ে প্রতিবাদ দেখাচ্ছে যে ইমরান খানকে ঘিরে উত্তেজনা থামার কোনো লক্ষণ নেই। তবে গুজবের এই ঢেউ পাকিস্তানের রাজনৈতিক বাস্তবতাকেই আরেকবার সামনে নিয়ে এসেছে—এই দেশে প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। স্বাধীনতার পর গত ৭৫ বছরে পাকিস্তানের একজন প্রধানমন্ত্রীও পূর্ণ পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করতে পারেননি।
৭৫ বছরে প্রায় ৩০ প্রধানমন্ত্রী, পূর্ণ মেয়াদ কেউই নয়
১৯৪৭ সালের পর থেকে পাকিস্তানে প্রায় ৩০ জন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্বে এসেছেন—যদি বহু মেয়াদে দায়িত্বে আসা নেতাদের আলাদা করে গণনা করা হয়। তবে বরাবরই তাদের রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়েছে অভিশপ্ত এক ঘূর্ণিতে—ক্ষমতার দরজা, তারপর বরখাস্ত, আইনি মামলা, গ্রেপ্তার, নির্বাসন এবং কখনো কখনও মৃত্যুদণ্ড। অন্তত ১৮ বার কোনো না কোনো কারণে প্রধানমন্ত্রীদের মেয়াদ শেষের আগেই বিদায় নিতে হয়েছে। কখনো সামরিক অভ্যুত্থান, কখনো বিচারিক সিদ্ধান্ত, কখনো প্রেসিডেন্টের বরখাস্ত—সব মিলিয়ে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক স্থিতি সবসময়ই নড়বড়ে।
১৯৭৩ সালের আগের প্রধানমন্ত্রীদের পরিণতি
স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান (১৯৪৭–১৯৫১) আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। তাঁর উত্তরসূরি খাজা নাজিমুদ্দিন (১৯৫১–১৯৫৩)কে গভর্নর-জেনারেল বরখাস্ত করেন। চৌধুরী মোহাম্মদ আলী (১৯৫৫–১৯৫৬) রাজনৈতিক সংঘাতের জেরেই পদত্যাগ করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৯৫৬–১৯৫৭)কে প্রেসিডেন্ট বরখাস্ত করেন এবং সামরিক শাসনকালে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী অভিযোগ আনা হয়। ফেরোজ খান নূন (১৯৫৭–১৯৫৮) বরখাস্ত হন ঠিক সামরিক শাসন জারির আগের মুহূর্তে।
১৯৭৩–পরবর্তী অশান্ত রাজনৈতিক ইতিহাস
সবচেয়ে মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছিল জুলফিকার আলি ভুট্টোর। ১৯৭৭ সালে জিয়াউল হকের সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৭৯ সালে বিতর্কিত বিচার প্রক্রিয়ায় তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
মোহাম্মদ খান জুনেজো (১৯৮৫–১৯৮৮)কে ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট বরখাস্ত করেন এবং তাঁকে গৃহবন্দি রাখা হয়েছিল বলে জানা যায়।
বেনজির ভুট্টো, পাকিস্তানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, দুবার দায়িত্বে থাকলেও দু’বারই দুর্নীতির অভিযোগে প্রেসিডেন্ট তাঁকে বরখাস্ত করেন। নির্বাসন, মামলা, এবং শেষ পর্যন্ত ২০০৭ সালে হত্যাকাণ্ড—তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল শোকাবহ।
নওয়াজ শরিফ, তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েও একবারও মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। প্রেসিডেন্টের বরখাস্ত, সামরিক অভ্যুত্থান, লন্ডনে নির্বাসন এবং অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অযোগ্য ঘোষণা—সব মিলিয়ে তাঁর ক্যারিয়ার পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভূমিকম্পের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
ইউসুফ রেজা গিলানি (২০০৮–২০১২) আদালত অবমাননার দায়ে সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা অযোগ্য ঘোষিত হন।
রাজা প্রভেজ আশরাফ (২০১২–২০১৩)ও ক্ষমতা ছাড়ার পর দুর্নীতির তদন্তে পড়েন।
শাহিদ খাকান আব্বাসী (২০১৭–২০১৮)কেও ২০১৯ সালে এলএনজি দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।
ইমরান খান: সর্বশেষ উদাহরণ
২০১৮ সালে নির্বাচিত ইমরান খান ২০২২ সালে অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হন—প্রায় সব বিরোধী দল তাঁর বিরুদ্ধে একজোট হয়েছিল। এরপর গ্রেপ্তার, একের পর এক মামলা, দণ্ড এবং কারাবাস—ইমরান খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে ঘিরে বিতর্ক থামেনি। তাঁর সমর্থকদের দাবি, এসব মামলা রাজনৈতিক প্রতিশোধের অংশ।
আদিয়ালা জেলের সামনে চলা বিক্ষোভ এবং গুজবের বিস্তার একথাই স্পষ্ট করে—পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী হওয়া শুধু ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছানো নয়, বরং চরম অনিশ্চয়তা ও বিপদের মুখোমুখি হওয়া।
