আজকাল ওয়েবডেস্ক: জার্মানির শান্তশিষ্ট রোটেনবুর্গ শহরের বাসিন্দারা দীর্ঘদিন ধরে একজন মানুষকে সাধারণ, সহৃদয় ও পরোপকারী প্রতিবেশী হিসেবেই চিনতেন। ৪২ বছর বয়সী কম্পিউটার প্রযুক্তিবিদ আর্মিন মেইভেস বাড়ির গাড়ি মেরামত করে দিতেন, আশেপাশের লন কেটে দিতেন এবং প্রায়ই প্রতিবেশীদের নিজের বাড়িতে খাওয়াতেন। কিন্তু তার স্বাভাবিক মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক শিউরে ওঠার মতো সত্য—তিনি ছিলেন স্বঘোষিত নরখাদক।
মেইভেস বহু বছরের অন্ধকার ফ্যান্টাসি পূরণ করার জন্য ৪৩ বছর বয়সী বার্লিনের প্রকৌশলী বার্ন্ড ব্র্যান্ডেসকে নিজের প্রেমের ফাঁদে টেনে আনেন। এই হত্যাকাণ্ড ও নরখাদকতার ঘটনা জার্মান ফৌজদারি ইতিহাসের অন্যতম অদ্ভুত ও বিতর্কিত বিচার প্রক্রিয়ার জন্ম দেয়।
২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম বিচারের প্রথম দিনেই মেইভেস আদালতে স্বীকার করেন যে ছোটবেলা থেকেই মানুষের মাংস ভক্ষণ করার কল্পনা তার ছিল। প্রসিকিউটররা জানান, মাত্র আট বছর বয়স থেকেই তার এই বিকৃত প্রবৃত্তির শুরু, যা আরও তীব্র হয় ১৯৯৯ সালে তার মায়ের মৃত্যুর পর।
এরপর ২০০১ সালের মার্চে মেইভেস ইন্টারনেটে একটি বিজ্ঞাপন দেন—একজন “যুবক ও সুঠাম দেহের মানুষ, যিনি খাদ্য হতে আগ্রহী”। সেই বিজ্ঞাপনের উত্তর দেন বার্ন্ড ব্র্যান্ডেস। ৯ মার্চ সন্ধ্যায় ব্র্যান্ডেস মেইভেসের ফার্মহাউসে পৌঁছান। সেখানে উভয়ের সম্মতিতেই মেইভেস প্রথমে ব্র্যান্ডেসকে ২০টি ঘুমের ওষুধ এবং প্রচুর স্ন্যাপস খাওয়ান। পরে তার লিঙ্গ কেটে রান্না করে দু’জনেই তা খাওয়ার চেষ্টা করেন। ব্র্যান্ডেস তখন প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে ভুগছিলেন এবং এক পর্যায়ে গিয়ে বাথটবে শুয়ে পড়েন। এসময় মেইভেস নির্লিপ্তভাবে স্টার ট্রেকের একটি উপন্যাস পড়ছিলেন।
পরের দিন ভোরের দিকে মেইভেস একটি বড় ছুরি দিয়ে ব্র্যান্ডেসের গলায় আঘাত করে তাকে হত্যা করেন। পরে তার মরদেহ অংশে ভাগ করে ফ্রিজারে জমিয়ে রাখেন, যেখানে একটি টেকঅ্যাওয়ে পিজার পাশেই মানুষের দেহাংশ রাখা ছিল। মাথার খুলি বাড়ির বাগানে মাটিচাপা দেন। কয়েক সপ্তাহ ধরে তিনি দেহাংশ ডিফ্রস্ট করে জলপাই তেল ও রসুন দিয়ে রান্না করে খান। তদন্তকারীদের তিনি বলেন, প্রতিটি কামড়ে যেন ব্র্যান্ডেসের স্মৃতি তার কাছে আরও জীবন্ত হয়ে উঠছিল। তিনি আরও জানান, দক্ষিণ আফ্রিকার রেড ওয়াইন এবং সাজানো ডাইনিং টেবিলের পাশে বসে “পোর্কের স্বাদযুক্ত” সেই মাংস খেতেন।
ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর বিশ্বজুড়ে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আইনি মহলেও জটিলতা তৈরি হয়, কারণ জার্মানিতে নরখাদকতার জন্য পৃথক কোনও আইন ছিল না। তাই মেইভেসকে চার্জ করা হয় “যৌন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যা” এবং “মৃতদেহের অবমাননা”-র অভিযোগে।
তবে মেইভেস দাবি করেন, ব্র্যান্ডেস স্বেচ্ছায় মৃত্যু ও ভক্ষণে সম্মতি দিয়েছিলেন। সারা রাতের ভিডিও রেকর্ডিংয়েও ব্র্যান্ডেসের সম্মতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু প্রসিকিউটররা বলেন, ব্র্যান্ডেস গুরুতর মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন এবং তার মধ্যে ‘স্ব-ধ্বংসের প্রবল আকাঙ্ক্ষা’ ছিল।
এ ঘটনার পর মেইভেস আরও কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, যারা তার বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু এক ছাত্র মেইভেসের কাছে ইমেল পাঠিয়ে জানতে চান তিনি সত্যিই কাউকে হত্যা করেছেন কি না। মেইভেস স্বীকার করলে সেই ছাত্র বিষয়টি পুলিশকে জানায়। এরপর ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে কাসেল আদালত তাকে অনিচ্ছাকৃত হত্যার দায়ে আট বছর ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়।
কিন্তু ২০০৫ সালে ফেডারেল কোর্ট রায় বাতিল করে পুনর্বিচারের নির্দেশ দেয়। তারা বলেন, ভিডিওর প্রমাণ উপেক্ষা করে আদালত মেইভেসের হত্যার উদ্দেশ্য—যৌনসুখ লাভ—কে যথাযথভাবে বিবেচনা করেনি। ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে পুনর্বিচার শুরু হয়। আদালতে এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জানান, মেইভেস এখনো কিশোর ও যুবকদের মাংস খাওয়ার ফ্যান্টাসি লালন করেন এবং ভবিষ্যতে পুনরায় অপরাধ করার ঝুঁকি রয়েছে।
শেষ পর্যন্ত ২০০৬ সালের ১০ মে ফ্রাঙ্কফুর্টের উচ্চ আঞ্চলিক আদালত তাকে হত্যার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে আজীবন কারাদণ্ড দেয়।
রোটেনবুর্গের শান্ত জীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই বিভীষিকাময় ঘটনাটি আজও বিশ্বব্যাপী বিচিত্রতা, আইনি চ্যালেঞ্জ এবং মানব-মনস্তত্ত্বের অন্ধকার দিক নিয়ে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে।
