আজকাল ওয়েবডেস্ক: গাজা শহরের উপর ইজরায়েলি বাহিনীর ভয়াবহ আক্রমণ নতুন মাত্রা পেয়েছে। বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) থেকে ট্যাঙ্ক ও স্থলসেনা নিয়ে ইজরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) শহরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। একদিকে নির্বিচার বিমান ও আর্টিলারি হামলা, অন্যদিকে বহুতল ভবন ধ্বংস করে ফেলার ফলে গাজার মানবিক সংকট অকল্পনীয় স্তরে পৌঁছেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রক  জানিয়েছে, সরকারি হিসাব অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ৬৫ হাজার ছাড়িয়েছে।

ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু একে ‘সন্ত্রাসের ৫০ টাওয়ার’ ধ্বংস অভিযান বলে অভিহিত করেছেন। আইডিএফ দাবি করছে, এসব ভবনে হামাসের পর্যবেক্ষকরা অবস্থান করছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো স্পষ্ট ভাষায় জানাচ্ছে, এটি আসলে একটি পরিকল্পিত গণহত্যা। জাতিসংঘ কমিশন অফ ইনকোয়ারি ও ২০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা একযোগে এ আক্রমণকে গণহত্যা ঘোষণা করেছে এবং বিশ্বসম্প্রদায়কে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছে।

আরও পড়ুন:  ব্রিটেনের ডিফেন্স একাডেমিতে ইজরায়েলি শিক্ষার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে নতুন সিদ্ধান্ত

গাজা শহরের এক সময়কার ১০ লাখেরও বেশি অধিবাসীর মধ্যে অন্তত ৯০ শতাংশ এখন ঘরছাড়া। হাজার হাজার মানুষ তাবুতে ঠাঁই নিয়েছে, কিন্তু সেখানেও নিরাপত্তা নেই। জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজার মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। শিশু খাদ্যের ঘাটতি, অপুষ্টি এবং চিকিৎসা সেবার অভাবে অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। নাসের হাসপাতাল দুই দিন আগে জানিয়েছে, সাতজনের মৃত্যু হয়েছে—এর মধ্যে তিনজন নবজাতক ও চারটি ভ্রূণ, যাদের মৃত্যু হয়েছে মাতৃক অপুষ্টি ও যুদ্ধজনিত ট্রমার কারণে।

সর্বশেষ রাতে ইজরায়েলি হামলায় অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। আল-শিফা হাসপাতালে জানানো হয়েছে, নিহতদের অর্ধেকের বেশি গাজা শহরের বাসিন্দা। শাতি শরণার্থী শিবিরে এক মা ও তার শিশুর মৃত্যু হয়েছে। নুসেইরাত ক্যাম্পে আল-আওয়দা হাসপাতালে হামলায় প্রাণ হারান এক গর্ভবতী নারীসহ তিনজন। খান ইউনিসের পশ্চিমে মুওয়াসি এলাকায় তাবুতে আশ্রয় নেওয়া এক পরিবারও হামলার শিকার হয়েছে। শিশু হাসপাতাল রান্তিসিতেও বোমা হামলার ঘটনায় আইসিইউ রোগী ও অকালপ্রসূত শিশুদের সরিয়ে নিতে বাধ্য করা হয়েছে।

ইজরায়েলি হামলায় উত্তর গাজার টেলিফোন ও ইন্টারনেট সেবা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে আহতদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স ডাকাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। স্থানীয় সাংবাদিক ও মিডিয়ার পক্ষে তথ্য বাইরে পাঠানোও কঠিন হয়ে পড়েছে। রেগুলেটর ও স্থানীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, এ পদক্ষেপ জনগণকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ও অসহায় করার পরিকল্পিত অংশ।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় নতুন করে যুদ্ধবিরতির আলোচনা চলছিল। কিন্তু কাতারে বৈঠক চলাকালীন হামাস নেতাদের টার্গেট করে ইজরায়েলি হামলায় আলোচনার সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে যায়। এতে আরব দেশগুলো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। কাতার পররাষ্ট্র মন্ত্রক একে “গণহত্যার ধারাবাহিকতা” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এমনকি দীর্ঘদিনের মিত্র তুরস্কও এ ঘটনায় তীব্র অস্বস্তি প্রকাশ করেছে।

ইজরায়েলি কট্টর ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ, যিনি সম্প্রতি ভারতে সফরে এসেছিলেন, চাঞ্চল্যকর মন্তব্য করেছেন—যুদ্ধ-পরবর্তী গাজাকে ‘রিয়েল এস্টেট বোনাঞ্জা’ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। তিনি বলেছেন, “আমরা অনেক অর্থ ব্যয় করেছি, এখন পুনর্নির্মাণে লাভ ভাগাভাগির সময়।” এ মন্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।

যদিও ইজরায়েল বর্তমান যুদ্ধকে ‘আত্মরক্ষার পদক্ষেপ’ হিসেবে দাবি করছে—২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণে ১,২০০ ইজরায়েলি নিহত হওয়ার পর থেকে—প্যালেস্টাইনিদের দুঃখ যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের নাকবার সময় থেকে। তারপর থেকে প্রতিটি প্রজন্ম বারবার যুদ্ধের সাক্ষী। বর্তমানে গাজার অর্ধেক নিহতই নারী ও শিশু। একজন ১৬ বছরের কিশোর, যদি সে এখনো বেঁচে থাকে, অন্তত ছয়টি যুদ্ধের ভয়াবহতা ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছে।

গাজার বর্তমান পরিস্থিতিকে জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো আধুনিক কালের ভয়াবহতম মানবিক বিপর্যয় হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। তবুও আন্তর্জাতিক  শক্তিগুলোর দ্বিধা, নীরবতা ও লোকদেখানো কূটনৈতিক উদ্যোগ গণহত্যার ধারা থামাতে পারছে না। গাজার সাধারণ মানুষ এখন মৃত্যু, অনাহার ও বাস্তুচ্যুতির এক দুঃস্বপ্নে আটকে আছে, যেখানে কোনো নিরাপদ আশ্রয় আর অবশিষ্ট নেই।