আজকাল ওয়েবডেস্ক: ১৯৩১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মিউনিখের একটি অ্যাপার্টমেন্টে রক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় ২৩ বছর বয়সি গেলি রাউবালের নিথর দেহ। নিজের শোবার ঘরে পড়ে থাকা অবস্থায় তাঁর বুকে ছিল গুলির ক্ষত, আর মাটিতে পড়ে ছিল একটি পিস্তল। তদন্তে এটি আত্মহত্যা বলে জানানো হলেও, শুরু থেকেই মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। কারণ, যে অ্যাপার্টমেন্টে দেহটি উদ্ধার হয়, সেটি ছিল জার্মানির তৎকালীন বিতর্কিত রাজনৈতিক নেতা অ্যাডলফ হিটলারের মিউনিখের বাসভবন। গেলি ছিলেন তাঁর সৎ ভাইঝি।

গেলিকে প্রথম দেখা থেকেই হিটলার নাকি অস্বাভাবিকভাবে পছন্দ করতেন—এমন মন্তব্য করেছেন সমসাময়িক বেশ কয়েকজন সঙ্গী ও দলে থাকা নেতারা। ১৯২৫ সালে হিটলার তাঁর বাড়ির গৃহপরিচারিকার কাজের জন্য গেলির মা অ্যাঞ্জেলাকে আমন্ত্রণ জানান। অ্যাঞ্জেলা তাঁর দুই মেয়ে—গেলি ও এলফ্রিডেকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। তখন থেকেই হিটলারের চোখে পড়েন কিশোরী গেলি। পরবর্তীতে হিটলার অ্যাঞ্জেলাকে নিজের বড় বাড়িতে স্থানান্তরিত হতে বলেন, কিন্তু গেলিকে মিউনিখের অ্যাপার্টমেন্টে তাঁর সঙ্গেই থাকতে বলেন। গেলি সত্যিই সম্মতি দিয়েছিলেন কিনা নাকি বাধ্য হয়েছিলেন—তা নিয়ে পরে নানা প্রশ্ন উঠেছে। তবে চার বছর ধরে দুইজন একই অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন।

তাদের সম্পর্ককে ঘিরে বহু গুজব রটেছিল—কেউ বলেছে নিষিদ্ধ প্রেম, কেউ দাবি করেছে যৌন সম্পর্ক, কেউ বা বলেছেন দুইজনের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর নির্ভরতা ছিল। এমনও শোনা যায় যে নিজের শরীরে কামনা জাগাতে গেলিকে দিয়ে নিজের দেহে পেচ্ছাপ করাতেন হিটলার!  যদিও প্রমাণ পাওয়া যায়নি, কিন্তু বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বলেছেন যে হিটলার অত্যন্ত নিয়ন্ত্রণপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন। গেলির সঙ্গে কারা দেখা করতে পারবে, কোথায় যেতে পারবে, কোন স্কুলে ভর্তি হবে—সব কিছু তিনি নাকি নির্দেশ দিতেন। এমন অভিযোগও আছে যে হিটলার জানতে পেরে তাঁর গাড়িচালকের সঙ্গে গেলির বন্ধুত্ব গড়ে উঠছে, সঙ্গে সঙ্গে সেই কর্মীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন।

এই বাড়তি নিয়ন্ত্রণই গেলির মানসিক অবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল বলে মনে করেন অনেকে। গেলি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার হলেও তাঁর মৃত্যু নিয়ে তদন্ত অত্যন্ত সীমিত ছিল। আত্মহত্যার মতো পরিস্থিতি নয় বলে অনেকেই মনে করলেও কোনও  ময়নাতদন্ত করা হয়নি। গুলির আঘাতের দিক নিয়েও প্রশ্ন ওঠে—এটি কি সত্যিই আত্মহত্যা, নাকি অন্য কিছু? ঘটনার পর নানা গুজব ছড়ায়—গেলি নাকি গর্ভবতী ছিলেন, তাঁর নাক নাকি ভাঙা ছিল। কিন্তু কোনও  সরকারি নথি না থাকায় সত্যতা অন্ধকারেই থেকে যায়।

ঘটনার সময় হিটলার শহরের বাইরে ছিলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ রুডলফ হেস জানালে হিটলার নাকি প্রচণ্ড আঘাত পান। কয়েকদিন প্রায় নির্বাক অবস্থায় থাকেন। এমনও জানা যায়, তিনি নিজের জীবন শেষ করার কথাও বলেছিলেন। পরে তিনি মাংস খাওয়া ছেড়ে দেন, কারণ মাংস  তাঁকে নাকি গেলির মৃতদেহের কথা স্মরণ করিয়ে দিত।

গেলির মৃত্যু হিটলারকে যে মানসিকভাবে ভেঙে দিয়েছিল, তা বহু সূত্রেই এসেছে। নুরেমবার্গ বিচারে হারম্যান গোরিং বলেন, গেলির মৃত্যু “হিটলারের মানুষের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকেই বদলে দিয়েছিল।” হিটলার পরবর্তীতে গেলির ঘরটি সংরক্ষণ করে রাখেন এবং বছরে দুইবার সেখানে ফুল সাজিয়ে রাখতেন—তার জন্মদিন ও মৃত্যুর দিনে।

গেলি রাউবালের মৃত্যু নিয়ে রহস্য আজও কাটেনি। আত্মহত্যা, নাকি কোনো চাপের ফল, নাকি আরও ভয়ঙ্কর কিছু—এ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। তবে এটি স্পষ্ট যে এই ঘটনা হিটলারের ব্যক্তিগত জীবনের এক গভীরতম ধাক্কা হয়ে ওঠে। অনেকে মনে করেন, এই মুহূর্তের পর থেকেই হিটলারের মানসিক অবস্থা বদলে যায় এবং তিনি আরও নিষ্ঠুর, কঠোর, বিচ্ছিন্ন ও নির্মম হয়ে ওঠেন।

হিটলারের আলোকচিত্রগ্রাহক পরে মন্তব্য করেছিলেন—গেলি যদি বেঁচে থাকতেন, ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতো। তাঁর কথায়, “গেলির মৃত্যুই ছিল সেই সময়, যখন হিটলারের ভিতরে নিষ্ঠুরতার বীজ জন্ম নিতে শুরু করেছিল।”