আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারতের পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (পিএলএফএস)-এর সাম্প্রতিক তথ্য দেশের শ্রমবাজারে এক গভীর পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে। দেশের গ্রামীণ মহিলাদের কর্মসংস্থান অংশগ্রহণ এমনভাবে বেড়েছে যে জাতীয় স্তরে চাকরিবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছেন তাঁরাই। শহুরে মহিলাদের কর্মসংস্থান হার যেখানে প্রায় স্থবির, সেখানে গ্রামের মহিলারা ভারতের বিকাশগাথায় নতুন ভূমিকা নিচ্ছেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি কেবল পরিসংখ্যানের ওঠানামা নয়, বরং সামাজিক কাঠামো ও শ্রমবাজারে দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠনের ইঙ্গিত।
জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২৫-এর পিএলএফএস অনুযায়ী, দেশের মহিলা শ্রমশক্তি অংশগ্রহণ বেড়ে হয়েছে ৩৪.১ শতাংশ, যা গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই বৃদ্ধির প্রায় সম্পূর্ণ অংশ এসেছে গ্রামীণ মহিলাদের থেকে। গ্রামে মহিলা কর্মসংস্থানের হার জুনের ৩৫.২ শতাংশ থেকে সেপ্টেম্বরের ৩৭.৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বিপরীতে শহরে মহিলা কর্মসংস্থান স্থির রয়েছে ২৬.১ শতাংশে। সামগ্রিক বেকারত্ব সামান্য বেড়ে ৫.২ শতাংশ হয়েছে, তবে বিশেষজ্ঞদের মতে তা কাজ হারানোর কারণে নয়; বরং আরও বেশি মহিলা কাজের সন্ধানে আসায় শ্রমবাজারে নতুন চাহিদা তৈরি হচ্ছে।
গ্রামীণ মহিলাদের এই উত্থানে সরকারের দুটি প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে—এমজিএনআরইজিএস এবং ডে-এনআরএলএম। এমজিএনআরইজিএস গ্রামীণ পরিবারকে বছরে ১০০ দিনের নিশ্চয়তাপূর্ণ মজুরি-ভিত্তিক কাজ দেয়, ফলে বহু মহিলা প্রথমবারের মতো নিজেদের নামে উপার্জন করতে পারছেন। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ৪৪০.৭ লক্ষ মহিলা এই প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন, যা তাদের আর্থিক ক্ষমতায়ন এবং সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতাকে বাড়িয়েছে। অন্যদিকে দিনদয়াল অন্ত্যোদয় যোজনা–জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশন ১০ কোটি মহিলাকে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে সংগঠিত করেছে। এই গোষ্ঠীগুলি ঋণ, দক্ষতা, বাজারসুবিধা এবং যৌথ নেতৃত্ব গড়ার সুযোগ তৈরি করেছে, যার ফলে গ্রামাঞ্চলে মহিলাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিচিতি ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে।
তবে কর্মসংস্থান বাড়লেও এর গুণগত মান নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। অধিকাংশ গ্রামীণ মহিলা যে ধরনের কাজে যুক্ত হচ্ছেন, তা মূলত অনানুষ্ঠানিক, অনিশ্চিত এবং সামাজিক সুরক্ষা-বিহীন। নিয়মিত বেতনভুক চাকরির পরিমাণ কমছে, স্বনিযুক্ত ও পরিবারের ব্যবসায় বিনা পারিশ্রমিকে কাজের হার বাড়ছে। এই প্রবণতা শহরেও দৃশ্যমান, যা প্রশ্ন তোলে—মহিলারা কি সত্যিই সুযোগের প্রয়োজনে শ্রমবাজারে আসছেন, নাকি আর্থিক চাপে বাধ্য হয়ে কাজ করতে নামছেন? অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, কৃষিক্ষেত্রে আয় কমে যাওয়া, ঋণের চাপ, এবং বিকল্প জীবিকার অভাব মহিলাদের শ্রমবাজারে ঠেলে দিচ্ছে। অর্থাৎ কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি অনেক ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসের চেয়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বেশি নির্ভরশীল।
এই বাস্তবতার মধ্যেও অগ্রগতির অন্য মাত্রা রয়েছে। শ্রমবাজারে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে মহিলার পারিবারিক ক্ষমতা ও সিদ্ধান্তগ্রহণে পরিবর্তন আসছে। উপার্জনের সুযোগ তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়াচ্ছে, পারিবারিক আলোচনায় তাঁদের ভূমিকা শক্তিশালী করছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির মাধ্যমে মহিলারা সঞ্চয়, ঋণ ব্যবস্থাপনা, এবং স্থানীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও স্বীকৃতি পাচ্ছেন। এই পরিবর্তন যদিও ধীর, তবে দীর্ঘমেয়াদে তা সমাজ ও অর্থনীতির কাঠামোতে গভীর ছাপ ফেলতে পারে।
২০১৭-১৮ সালে যেখানে গ্রামীণ মহিলাদের শ্রমশক্তি অংশগ্রহণ ছিল ২৪.৬ শতাংশ, ২০২৩-২৪ সালে তা বেড়ে প্রায় ৪৭.৬ শতাংশ হয়েছে—মাত্র ছয় বছরে প্রায় দ্বিগুণ। এটি দেখায় যে মহিলাদের শ্রমে যুক্ত হওয়ার সামাজিক বাধাগুলি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং তাঁরা ক্রমশ অর্থনীতির প্রধান শক্তি হিসেবে উঠে আসছেন।
তবে এই বৃদ্ধিকে স্থায়ী করতে হলে নীতি-পরিকল্পনায় বড় পরিবর্তন প্রয়োজন। শুধু কাজের সুযোগ বাড়ালেই হবে না; আয় স্থিরতা, দক্ষতা উন্নয়ন, সম্পত্তির অধিকার, ঋণপ্রাপ্তি, এবং অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্য-পেনশনসহ সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। গ্রামীণ মহিলাদের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অ্যাগ্রো-প্রসেসিং, গ্রামীণ ম্যানুফ্যাকচারিং, ডিজিটাল পরিষেবা—এ ধরনের নতুন ক্ষেত্রের দক্ষতা বাড়ানো হলে তাঁদের শ্রম আর্থিক উন্নয়নে রূপান্তরিত হতে পারে। একইভাবে শহর-গ্রামের বৈষম্য দূর করতেও সমন্বিত নীতি প্রয়োজন, যেখানে গ্রামাঞ্চলের নারীকেন্দ্রিক মডেল শহুরে শ্রমনীতিকেও প্রভাবিত করতে পারে।
গ্রামের মহিলাদের এই নীরব উত্থান শুধু অর্থনৈতিক পরিমাপেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি সমাজ, রাজনীতি এবং স্থানীয় ক্ষমতার পরিসরকে বদলে দিচ্ছে। ভারতের উন্নয়নগাথা এতদিন পুরুষ-কেন্দ্রিক বৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল ছিল, এখন ধীরে ধীরে কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসছেন গ্রামীণ মহিলারা। তাঁদের শ্রম দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, পাশাপাশি উন্নয়নবোধের নতুন মানদণ্ড তৈরি করছে।
শেষ পর্যন্ত ভারতের অগ্রগতি শুধু সংখ্যায় মাপা যাবে না। প্রকৃত উন্নয়ন তখনই ঘটবে, যখন গ্রামীণ নারীরা তাঁদের শ্রমকে অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন, সামাজিক মর্যাদা এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় রূপ দিতে পারবেন। আজ যে পরিবর্তন গ্রামবাংলার নারীরা সৃষ্টি করছেন, তা ভারতের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন-পথকে নতুন দিশা দেখাচ্ছে।
