আজকাল ওয়েবডেস্ক: নিষিদ্ধ ঘোষিত সিপিআই (মাওবাদী) সংগঠনের এক মহিলা সদস্য আত্মসমর্পণ করেছেন তেলেঙ্গানা পুলিশের কাছে। সোমবার মুলুগু জেলার পুলিশ সুপার শবরীশ পি-র কাছে ওই ৩০ বছর বয়সী মহিলা আত্মসমর্পণ করেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

পুলিশের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ছত্তীসগড়ের বাসিন্দা ওই মহিলা দীর্ঘদিন ধরে মাওবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সম্প্রতি তিনি বুঝতে পারেন যে, সরকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। পাশাপাশি আত্মসমর্পণ করা মাওবাদীদের পুনর্বাসনের জন্য তেলেঙ্গানা সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটিও তাঁর সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা নেয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “তিনি অস্ত্রের পথ ছেড়ে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতে এবং মূলধারার সমাজে যোগ দিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”
পুলিশ জানিয়েছে, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের মোট ৮৫ জন মাওবাদী মুলুগু জেলা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। কর্তৃপক্ষের মতে, সরকারের পুনর্বাসন নীতিই এই আত্মসমর্পণের ধারাকে আরও উৎসাহিত করছে।

পুলিশ সূত্রে আরও জানা গেছে, আত্মসমর্পণকারী ওই মহিলা এখন সরকারের পুনর্বাসন ও সহায়তা প্রকল্পের আওতায় আসবেন। তাঁকে সমাজে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রশাসন প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তেলেঙ্গানা পুলিশ জানিয়েছে, মাওবাদী দমন অভিযানের পাশাপাশি তারা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও কাজ করছে—যাতে জঙ্গলে থাকা যুবক-যুবতীরা উন্নয়নের ধারায় ফিরে এসে শান্তিপূর্ণভাবে জীবন শুরু করতে পারেন।

চলতি বছরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মাওবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বহু সদস্য আত্মসমর্পণ করেছেন। নিরাপত্তা বাহিনীর লাগাতার অভিযান, সরকারের পুনর্বাসন প্রকল্প, এবং স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নমূলক কর্মসূচির বিস্তারের ফলে এই আত্মসমর্পণের ঢল দেখা যাচ্ছে। ২০২৫ সালের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু ছত্তীসগড় রাজ্যেই এখন পর্যন্ত প্রায় ১,০৪০ জন মাওবাদী আত্মসমর্পণ করেছেন—যা সাম্প্রতিক বছরগুলির মধ্যে সর্বাধিক। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ অভিযানের ফলে বনাঞ্চলভিত্তিক সংগঠনের প্রভাব অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।

অক্টোবর মাসেই এক ব্যতিক্রমী ঘটনায় ছত্তীসগড়ে একদিনে ১৭০ জন এবং দু’দিনে মোট ২৫৮ জন মাওবাদী আত্মসমর্পণ করেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন স্থানীয় ‘এরিয়া কমান্ডার’ ও ‘ডেপুটি কমান্ডার’-স্তরের নেতা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই ঘটনাকে “মাওবাদবাদের অবসানের সূচনা” বলে বর্ণনা করেন। একইসঙ্গে তিনি জানান, ২০২৬ সালের মধ্যে সরকার ‘নক্সাল মুক্ত ভারত’ গঠনের লক্ষ্য নিয়েছে।

শুধু নিম্নস্তরের কর্মী নয়, সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যেও ভাঙন দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি মহারাষ্ট্র-ছত্তীসগড় সীমান্তে দীর্ঘদিন সক্রিয় থাকা মাওবাদী নেতা মল্লোজুলা ভেনুগোপাল রাও, যিনি সংগঠনের ‘ভূপতি’ নামে পরিচিত ছিলেন, তাঁর ৬১ জন সহযোগীসহ আত্মসমর্পণ করেছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “আমরা অস্ত্র ছেড়ে মানুষের অধিকারের জন্য শান্তিপূর্ণ উপায়ে কাজ করব।” বিশ্লেষকদের মতে, এটি সিপিআই (মাওবাদী)-এর নেতৃত্ব কাঠামোতে একটি বড় ধাক্কা।

অন্যদিকে, মহিলা মাওবাদীদের মধ্যেও আত্মসমর্পণের প্রবণতা বেড়েছে। ছত্তীসগড়ের কামলা সোড়ি, যার মাথার দাম ছিল ১৭ লাখ টাকা, এবং মধ্যপ্রদেশের ২২ বছর বয়সী সুনীতা, যার বিরুদ্ধে ১৪ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা ছিল—দুজনেই সম্প্রতি আত্মসমর্পণ করেছেন। তেলেঙ্গানায়ও এক ৩০ বছর বয়সী মহিলা মাওবাদী, যিনি ছত্তীসগড়ের বাসিন্দা, শান্তিপূর্ণ জীবনে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে পুলিশের হাতে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি জানান, সরকার আদিবাসী উন্নয়ন এবং আত্মসমর্পণকারীদের পুনর্বাসনের যে পরিকল্পনা নিয়েছে, তা তাঁর সিদ্ধান্তে বড় প্রভাব ফেলেছে।

এই ধারাবাহিক আত্মসমর্পণকে অনেকেই ভারতের অভ্যন্তরে দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র আন্দোলনের দুর্বলতার ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। রাষ্ট্রীয় দমননীতির পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনের উন্নয়নকেন্দ্রিক উদ্যোগ—যেমন রাস্তা নির্মাণ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, বিদ্যালয় ও পানীয় জলের প্রকল্প—এলাকাগুলিকে সরকারের প্রশাসনিক পরিসরে নিয়ে এসেছে। তাছাড়া, বনভূমি ও সম্পদ নিয়ে আদিবাসীদের মধ্যে যে বঞ্চনা থেকে মাওবাদী আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল, আজ তার অনেক দিকেই কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।

তবুও সমাজবিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন যে কেবল অস্ত্র সমর্পণই শান্তি ফিরিয়ে আনার চূড়ান্ত পথ নয়। যেসব অঞ্চলে এই আত্মসমর্পণ ঘটছে, সেসব স্থানে ভূমি অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবিকা নিয়ে সমস্যা এখনও গভীর। অনেক ক্ষেত্রেই আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীরা সমাজে একীভূত হতে গিয়ে নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। সুতরাং, এই আত্মসমর্পণগুলিকে একমাত্র নিরাপত্তা নীতির সাফল্য হিসেবে দেখা উচিত নয়, বরং এটি ভারতের গ্রামীণ ও বনাঞ্চলভিত্তিক অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক পরিবর্তনের একটি ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন।

বর্তমানে কেন্দ্র ও রাজ্য প্রশাসন একযোগে কাজ করছে আত্মসমর্পণকারীদের পুনর্বাসন, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সমাজে ফিরিয়ে আনতে। সরকারের নীতি অনুযায়ী, আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীরা আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং আবাসন সুবিধা পান। একই সঙ্গে তাঁদের আইনি মামলাগুলিও ধাপে ধাপে প্রত্যাহার করা হচ্ছে, যাতে তাঁরা শান্তিপূর্ণ জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করতে পারেন।

অস্ত্র সমর্পণের এই সাম্প্রতিক ঢল ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ সংকেত রেখে যাচ্ছে—একদিকে সশস্ত্র আন্দোলনের প্রভাব কমছে, অন্যদিকে রাষ্ট্র নতুনভাবে “উন্নয়ন” ও “সমন্বয়”-এর ভাষায় শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নিচ্ছে। তবে এই শান্তির ভিত্তি কতটা স্থায়ী হবে, তা নির্ভর করছে সরকার কীভাবে বাস্তবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক বঞ্চনা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সামাজিক বৈষম্যের সমস্যাগুলি সমাধান করতে পারে তার ওপর।