আজকাল ওয়েবডেস্ক: সময়টা ২০০২ সাল। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বাম সরকারের শাসন, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার। সেই বছর কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নেয় ভোটার তালিকার ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’ (এসআইআর) হবে এবং হলও তাই। ২০০১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের পরেই ২০০২ সালে এসআইআর হয় পশ্চিমবঙ্গ-সহ একাধিক রাজ্যে। এরপর বেশ কয়েক বছরে রাজ্য রাজনীতিতে বহু জল বয়ে গিয়েছে। বাম সরকারের পতন ঘটেছে, ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রে শাসকদল বিজেপি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ২৩ বছর পর পশ্চিমবঙ্গ-সহ একাধিক রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে আবারও সিদ্ধান্ত, এসআইআর হবে এবং পশ্চিমবঙ্গ-সহ যে সমস্ত রাজ্যে ভুয়ো ভোটার, মৃত ভোটার-সহ একাধিক যে অবৈধ ভোটার রয়েছে ভোটার তালিকাতে, তাদের সরাতে হবে। একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা তৈরি করা হবে। এমনটাই দাবি বাংলার বিরোধীদল বিজেপির তথা কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের। আর যেমন ভাবা তেমনি কাজ। শুরু হল এসআইআর প্রক্রিয়া। কিন্তু কেন্দ্রের কি সদিচ্ছা রয়েছে ভোটার তালিকা সংশোধনের? না কি এর নেপথ্যে রয়েছে অন্য কোনও রাজনৈতিক চক্রান্ত?
পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনীতির পরিসরে তৃণমূলকে কটাক্ষ করতে গিয়ে বারবার বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিক থেকে শুরু করে মুনি-ঋষিদের নিয়ে নানা কুরুচিকর এবং অপমানজনক মন্তব্য করতেও শোনা গিয়েছে বিজেপির নেতাদের। কখনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কের বিভাজন ও বিতর্কিত অশালীন মন্তব্য করতে শোনা গিয়েছে। কখনও রবি ঠাকুর নিয়েও কুরুচিকর মন্তব্যের ফুলঝুরি ফুটেছে বিজেপির নেতাদের মুখে। এই নিয়ে তৃণমূল বারবার সরব হয়েছে।
এ বার বাংলা ও বাঙালির অপমান এবং রবি ঠাকুর ও বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে বেলাগাম বেনজির মন্তব্যের বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন ‘দেশ বাঁচাও’ গণমঞ্চের বিদ্যজনেরা। প্রথমে প্রতিবেশী রাজ্য অসমের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা ৭৪ বছর বয়সি কংগ্রেস কর্মী বিধূভূষণ দাসকে দেশদোহী বলে মামলা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাওয়ার অপরাধে। আবার কর্ণাটক রাজ্যের বিজেপি সাংসদ বিশ্বেশ্বর হেগড়ে কাগেরি দাবি করেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জনগণমন’ ব্রিটিশদের স্বাগত জানাতে লিখেছিলেন। আসলে বন্দেমাতরমকেই জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল, পরবর্তীকালে দু’টিই রয়ে গিয়েছে। এত বড় অপবাদের পরও, বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চক্রান্তের পরও বাঙালিরা চুপ থাকবে, সবটা মেনে নেবে, সেটা হয় না। তাই রবিবার, কলকাতা প্রেস ক্লাবে এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই সরব হল দেশ বাঁচাও গণমঞ্চ।
এই সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন শ্রম ও কৃষি মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু, অধ্যাপিকা সৈয়দ তনভীর নাসরিন, জাতীয় বাংলা সম্মেলনের সভাপতি সিদ্ধব্রত দাস, সমাজকর্মী বাসুদেব ঘটক, বর্ণালী মুখার্জি, অধ্যাপক শামিম আহমেদ, সমাজকর্মী সুশান রায়, অভিনেত্রী সোমা চক্রবর্তী, অভিনেতা ভিভান ঘোষ, অভিনেতা রাহুল চক্রবর্তী, অভিনেতা বীরেশ চক্রবর্তী, সঙ্গীত শিল্পী নাজমুল হক ও অমিত কালি এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুমন ভট্টাচার্য-সহ আরও বিশিষ্টজনেরা। ‘দেশ বাঁচাও’ গণমঞ্চের সদস্যদের বক্তব্যে মূল বিষয়টি পরিষ্কার, বিজেপি বাঙালির চিন্তনে, মননে ভাঙন ধরাতে সচেষ্ট, তাই বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বিভেদ তৈরি করার তীব্র প্রচেষ্টা।
এদিন অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশিষ্ট সাংবাদিক তথা রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, “বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথ দু’জনেই বাঙালির প্রাণপুরুষ। দু’জনেই বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র। না বঙ্কিমচন্দ্র বিজেপির, না রবীন্দ্রনাথ। তাই বাঙালির কাছে বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ কী তা বিজেপির নেতারা বা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বুঝবেন না। বঙ্কিমচন্দ্রের সার্ধশতবর্ষকে অবলম্বন করে যারা ২০২৬-এর নির্বাচন অতিক্রম করতে চাইছে, যখন ২০২৬-এর ফলাফল তারা দেখবে, তখন আবারও বঙ্কিমচন্দ্রকে বিস্মৃত হবে, সেটাই স্বাভাবিক।”
সাংবাদিক সম্মেলনে অধ্যাপিকা সৈয়দ তনভীর নাসরিন তাঁর বক্তব্যে মনে করিয়ে দিয়েছেন বন্দেমাতরম এবং জনগণমন অধিনায়ক গান দু’টির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। সঙ্গে এটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন, যে ১৮৯৬ সালে প্রথম কংগ্রেস অধিবেশনে যখন বন্দেমাতরম গানটি গাওয়া হয়, তখন সেই গানটি গাওয়ার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। পরবর্তীকালে বঙ্গভঙ্গ রদের প্রেক্ষাপটে ১৯১১ সালে কংগ্রেসের ২৬তম অধিবেশনে জনগণমন অধিনায়ক গাওয়া হয়।
এখন প্রশ্ন হল, তাহলে বিজেপি সাংসদ কী হিসেবে দাবি করলেন যে, ইংরেজদের স্বাগত জানানোর জন্য এই গান গাওয়া হয়েছিল? ‘দেশ বাঁচাও’ গণমঞ্চের সিদ্ধব্রত দাস, বাসুদেব ঘটক, শামিম আহমেদ, বর্ণালী মুখার্জি-সহ অন্যান্যদের বক্তব্যেও এটাই স্পষ্ট যে, বিজেপি একটি রবীন্দ্রনাথ-বিরোধী দল। বিজেপি সব সময় যে হিন্দুত্বের কথা বলে, সেই তত্ত্বের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মানবতার তত্ত্ব মেলে না বলেই তাঁর উপর এত রাগ, এত বিদ্বেষ। তাই তারা বঙ্কিমচন্দ্রকে ঢাল বানিয়ে রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করতে চাইছে। কিন্তু তারা জানে না, বাঙালির কাছে দু’জনেই অতি শ্রদ্ধার, তাই এভাবে বাংলা ও বাঙালিকে কব্জা করা একটু মুশকিলই বলে মনে হয়।
পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকার সংশোধনী প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তৃণমূল এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলি ময়দানে নেমে পড়ছে। তাদের অভিযোগ, বিজেপি ও কেন্দ্র সরকার মিলিতভাবে চক্রান্ত করে এসআইআর-এর মাধ্যমে ঘুরপথে এনআরসি করার চেষ্টা করছে। যা তারা কোনভাবেই মেনে নেবে না। এই নিয়ে ২১ জুলাই মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন বিজেপির পরিচালিত কেন্দ্র সরকার ও বাংলার প্রধান বিরোধী দলকে। মমতা-সহ রাজ্যে শাসকদলের একাধিক নেতৃত্ব বারবার বলেছেন, এসআইআর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিয়ম মেনে হলে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু এসআইআর-এর নাম করে ঘুরপথে এনআরসি করা যাবে না। এসআইআর-এর ঘোর বিরোধিতায় পথেও নেমেছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো।
