আজকাল ওয়েবডেস্ক: ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০২৪-এ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা তিনটি সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন ইউনিট অনুমোদন করে। এর মধ্যে দুটি ইউনিট টাটা গোষ্ঠী পরিচালনায় হবে। ভারত সরকার ‘সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন উৎসাহ পরিকল্পনা’র আওতায় মোট ব্যয়ের ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। শুধু টাটা গোষ্ঠীর দুটি ইউনিটের ক্ষেত্রেই এই ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৪,২০৩ কোটি টাকা।
ক্যাবিনেটের এই অনুমোদনের চার সপ্তাহ পর, এপ্রিল ২০২৪-এ টাটা গোষ্ঠী বিজেপিকে ৭৫৮ কোটি টাকা দান করে। নির্বাচন কমিশনে জমা পড়া দলীয় অনুদানের নথি অনুযায়ী ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে কোনও রাজনৈতিক দলকে দেওয়া এটিই সবচেয়ে বড় কর্পোরেট অনুদান। মোট ১৫টি টাটা গোষ্ঠীর সংস্থা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৯১৫ কোটি টাকা রাজনৈতিক দলকে দিয়েছে। এই অনুদান ট্রান্সফার করা হয় টাটা গোষ্ঠীর প্রগ্রেসিভ ইলেক্টোরাল ট্রাস্টের মাধ্যমে। সবচেয়ে বেশি অনুদান দিয়েছে টাটা সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, যার পরিমাণ ৩০৮ কোটি টাকা।
বিজেপির পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অনুদান পেয়েছে কংগ্রেস, যার পরিমাণ ৭৭.৩ কোটি টাকা—যা বিজেপি পাওয়া অনুদানের মাত্র দশভাগের এক ভাগ। আরও আটটি রাজনৈতিক দল—তৃণমূল কংগ্রেস, ডিএমকে, শিবসেনা, বিজেডি, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, জেডিইউ, লোক জনশক্তি পার্টি (রামবিলাস) এবং ভারত রাষ্ট্র সমিতি—প্রতিটি ১০ কোটি টাকা করে পেয়েছে।
এই অনুদানের ধারা আরও একটি বড় প্রবণতার ইঙ্গিত দেয়—সরকারি সুবিধা পাওয়া কর্পোরেট সংস্থাগুলোর বড় অংশই পরে বিজেপিকে অনুদান দিয়েছে। মন্ত্রিসভা অনুমোদিত তৃতীয় সেমিকন্ডাক্টর প্রকল্পটি কর্ণাটক-ভিত্তিক মুরুগাপ্পা গোষ্ঠী পরিচালনা করবে। সরকার সেখানে মোট ব্যয়ের অর্ধেক, অর্থাৎ ৩,৫০১ কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। অনুমোদনের কয়েক দিনের মধ্যেই এই গোষ্ঠী বিজেপিকে ১২৫ কোটি টাকা দান করে।
একই ধরণের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় কায়েন্স টেকনোলজির ক্ষেত্রেও। সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর রমেশ কুণিকান্নান ২০২৩-২৪ সালে বিজেপিকে ১২ কোটি টাকা দান করেন। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর প্রতিষ্ঠান, কায়েন্স সেমিকন প্রাইভেট লিমিটেড, গুজরাটের সানন্দে সেমিকন্ডাক্টর প্রকল্পের অনুমোদন পায়।
টাটা গোষ্ঠীর প্রগ্রেসিভ ট্রাস্ট ২০২১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত কোনও রাজনৈতিক অনুদান দেয়নি। কিন্তু ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে ৭৫৮ কোটি টাকার রেকর্ড ট্রান্সফার হয়। এই বিষয়ে টাটা সন্স এবং ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রকের কাছে প্রশ্ন পাঠানো হলেও কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।
২০২১ সালে ভারত সরকার ‘ইন্ডিয়া সেমিকন্ডাক্টর মিশন’ চালু করে, যার লক্ষ্য ছিল দেশের ভিতরে সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করা। কোভিড-১৯ মহামারির সময় গাড়ি শিল্পে চিপ সংকট বিশেষভাবে নজরে আসে, এবং সেই প্রেক্ষাপটেই সরকারি নীতি পুনর্গঠিত হয়। এই মিশনের আওতায় কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়াও রাজ্য সরকারগুলোও অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা দিচ্ছে।
টাটা গোষ্ঠী ইতিমধ্যেই সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে প্রবেশের প্রস্তুতি শুরু করেছিল। ২০২১ সালে তারা একটি টেলিকম সংস্থা অধিগ্রহণ করে, যা পরে একটি ভারতীয় সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নেয়। ২০২২ ও ২০২৩ সালে জাপানের রেনেসাস ইলেকট্রনিক্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাইক্রন টেকনোলজির সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্বও ঘোষণা করা হয়।
মন্ত্রিসভার অনুমোদন অনুযায়ী, গুজরাটের ধোলেরা এবং আসামের মোরিগাঁওয়ে টাটার দুটি ইউনিট স্থাপিত হবে। সরকারি হিসাবে, এই প্রকল্পগুলোতে টাটা গোষ্ঠী মোট ১.১৮ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে এবং প্রায় ৪৬,০০০ সরাসরি ও পরোক্ষ চাকরি তৈরি হবে। এর একটি বড় অংশই সরকারি ভর্তুকির আওতায়।
অনুমোদনের দিন টাটা ইলেকট্রনিক্সের সিইও রন্ধীর ঠাকুর বলেন, “এটি ভারতের জন্য নতুন যুগের সূচনা। বিশ্বব্যাপী সেমিকন্ডাক্টর ইকোসিস্টেমকে শক্তিশালী করতে টাটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পেরে গর্বিত।” ঠিক এক মাস পরেই বিজেপির অ্যাকাউন্টে জমা হয় ৭৫৮ কোটি টাকা—ভারতের রাজনৈতিক অনুদানের ইতিহাসে অন্যতম বৃহত্তম এককালীন কর্পোরেট দান হিসেবে তা চিহ্নিত হচ্ছে। তবে এই অনুদানের সময়কাল নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও কেন্দ্র এবং কর্পোরেট পক্ষ এ বিষয়ে এখনো নীরব।
