আবু হায়াত বিশ্বাস, দিল্লি: সিকল সেল অ্যানিমিয়া নির্মূলে উদ্যোগী কেন্দ্র। এই রোগ নির্মূলে লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে ২০৪৭ সাল। আক্রান্তদের রক্তে জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে সিকল সেল অ্যানিমিয়া মুক্ত করার লক্ষ্যে আরও একধাপ এগোল ভারত। বুধবার দিল্লিতে দেশের অন্যতম প্রতিষেধক নির্মাণ সংস্থা সিরামের সঙ্গে গাঁটছড়া বাধে সিএসআইআর-আইজিআইবি। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং।

 

ভারতীয় বিজ্ঞানী, সিএসআইআর-আইজিআইবি-র ডঃ সৌভিক মাইতি এবং ডঃ দেবজ্যোতি চক্রবর্তী প্রচলিত সিআরআইএসপিআর টুলকে ছাড়িয়ে একটি অত্যন্ত নির্ভুল এবং দক্ষ জিনোম-এডিটিং ব্যবস্থা তৈরি করেছেন। দিল্লির ইনস্টিটিউট অব জেনোমিক্স অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজি (আইজিআইবি)-এর সেই দুই বাঙালি সৌভিক মাইতি ও দেবজ্যোতি চক্রবর্তী দেশ থেকে সিকল সেল অ্যানিমিয়া দূর করার লক্ষ্যে জুটি বেঁধেছেন। করোনা কালে ঘরে বসে কোভিড পরীক্ষা করার জন্য এফএন-ক্যাস৯ এডিটর-লিঙ্কড ইউনিফর্ম ডিটেকশন অ্যাসে বা সংক্ষেপে ‘ফেলুদা’ টেস্ট কিট বানিয়েছিলেন সৌভিক, দেবজ্যোতি জুটি। সিকেল সেল ডিজিজ নিরাময়ে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বল্পমূল্যের জিন থেরাপি তৈরির লক্ষ্যে সিএসআইআর-এর ইনস্টিটিউট অফ জিনোমিক অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজি ও সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া-র মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় বুধবার। 

এদিন গবেষক দেবজ্যোতি চক্রবর্তী জানালেন,‘সিকল সেল অ্যানিমিয়া মূলত ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপকভাবে দেখা যায়। বংশানুক্রমিক ভাবে প্রাপ্ত রোগ এটি। যাতে মানব শরীরের স্বাভাবিক গোলাকার লোহিত বা লাল রক্তকণিকাগুলির আকার পাল্টে গিয়ে কোষগুলি কাস্তে বা কাস্তের আকার ধারণ করে। এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আটকে যায়,  অক্সেজেন বহনের ক্ষমতা কমে যায়। অক্সিজেন পৌঁছতে পারেনা। এর ফলে অল্পবয়সে মৃত্যু হয়। বাংলা, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড়ের জনজাতিদের মধ্যে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। আফ্রিকাতেও এটি দেখা যায়।’ দেবজ্যোতি দাবি করলেন, জিন থেরাপির ফলে রোগ নিরাময় সম্ভব। ডিএনএ-‌র মধ্যে অক্ষরকে বদলে দেওয়া যায়, এবং রোগ নিরাময় সম্ভব হয়। গবেষকরা জানাচ্ছেন, জিনগত চিকিৎসাকে কাজে লাগিয়ে রোগীর ডিএনএ-তে যে বিন্যাসজনিত সমস্যা রয়েছে, তা ঠিক করাই তাঁদের লক্ষ্য। এই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্রিসপর জিনোম এডিটিং পদ্ধতি।


এই রোগকে নির্মূল করার লক্ষ্যে সম্প্রতি জাতীয় মিশন ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। এদিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং জানান, এই উদ্ভাবন ভারতের সিকল সেল–মুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের দিকে বড় পদক্ষেপ। আত্মনির্ভর ভারতের উন্নত চিকিৎসা প্রযুক্তির অবস্থানকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করবে। জানা গিয়েছে, এই থেরাপি বিদেশে চিকিৎসার খরচ প্রায় ২০-‌২৫ কোটি টাকা, সেই তুলনায় অত্যন্ত কম খরচে ভারতেই তৈরি হবে এর প্রতিষেধক। সিরামের সঙ্গে গাঁটছড়ার বাধার ফলে সাশ্রয়ী হবে বলে দাবি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর। এদিনের অনুষ্ঠানে সিএসআইআর-‌ আইজিআইবি ও সিরাম ইনস্টিটিউট ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি হস্তান্তর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই প্রযুক্তি তৈরিরই মূল কারিগর হলেন মেদিনীপুরের ময়নার সন্তান সৌভিক ও কলকাতার দেবজ্যোতি। আমেরিকার পেটেন্টও পেয়েছেন তাঁরা। এদিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বক্তব্যে দুই বাঙালি সন্তানের প্রশংসা শোনা যায়।


কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং দাবি করেন, ভারত ইতিমধ্যেই সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে কোভিড-‌১৯, এইচপিভি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভ্যাকসিন তৈরি করে বিশ্বমঞ্চে সাফল্য দেখিয়েছে। এবার সেই পথেই এগোবে জিন থেরাপিও। জিতেন্দ্র সিং বলেন, এই উদ্ভাবন দেশের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, বিশেষত মধ্য ও পূর্ব ভারতের আদিবাসী অঞ্চলে যেখানে সিকেল সেল ডিজিজ এর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। অনুমান অনুযায়ী, আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতি ৮৬টি জন্মের মধ্যে ১টিতে সিকেল সেল ডিজিজ দেখা দেয়। সিরামের একজিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. উমেশ শলিগ্রাম বলেন, ‘বিশ্বে জিন থেরাপির খরচ তিন মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। আমাদের লক্ষ্য হল – ভারতীয় উদ্ভাবনকে সবচেয়ে দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সস্তা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে আমরা ইতিমধ্যেই ৩০ মিলিয়নেরও বেশি প্রাণ বাঁচিয়েছি, এবার সিকল সেল অ্যানিমিয়া রোগ মুক্ত ভারত গড়তে কাজ করব।’

ছবি— দুই বাঙালি গবেষক জুটি সৌভিক মাইতি, দেবজ্যোতি চক্রবর্তী।