আজকাল ওয়েবডেস্ক: মহারাষ্ট্রজুড়ে মুসলিম কুরেশি সম্প্রদায়ের কসাইরা গত এক মাসের বেশি সময় ধরে এক অভিনব প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দশকব্যাপী হিন্দুত্ববাদী "গোরক্ষক"দের হাতে বারবার হিংসাত্মক হামলার শিকার হয়ে এবার তারা নিজেদের পেশা—মাংস ব্যবসা—সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই সিদ্ধান্ত শুধু তাদের জীবিকার উপর বিপর্যয় ডেকে আনছে না, এটি সম্ভবত প্রথমবার, যখন এমন বৃহৎ ও সংগঠিতভাবে সম্প্রদায়ের ভেতর থেকেই এক নির্ভীক প্রতিবাদ উঠে এল।

২০১৫ সালের মার্চে বিজেপি সরকারের আমলে মহারাষ্ট্র পশু সংরক্ষণ আইন, ১৯৭৬-এ সংশোধনী আনা হয়। নতুন আইনে গরু, ষাঁড়, বলদ ইত্যাদি গো-জাত পশুদের জবাই নিষিদ্ধ করা হয়। এর পর থেকেই রাজ্যে মুসলিম কসাইদের উপর হিংসা বৃদ্ধি পায়। যদিও মহিষের জবাই নিষিদ্ধ নয়, তবু কুরেশি সম্প্রদায়ের দাবি—মুসলিমদের মাংস ব্যবসায় দেখলেই গোরক্ষকরা হামলা চালায়, এবং পুলিশ বেশিরভাগ সময় তাদের রক্ষা করে না।

নানদেড় জেলার কুরেশি জামাতের প্রধান আজিজ কুরেশি বলেন, "আমরা দীর্ঘদিন ধরেই গরুর মাংস বিক্রি বন্ধ করেছি। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। হামলাকারীদের কাছে একজন মুসলিম কসাই মানেই অপরাধী। এভাবে চলতে পারে না। তাই আমরা পেশা ত্যাগ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছি।"

 আরও পড়ুন: মর্মান্তিক! বন্যার খবর করতে গিয়ে সাংবাদিক নিজেই ভেসে গেলেন বন্যার জলে

নানদেড়, পরভনী, লাতুর সহ নানা জেলায় প্রতিদিন কুরেশি জামাত বিভিন্ন সভার মাধ্যমে সদস্যদের এই আন্দোলনে যোগ দিতে আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত শুধু কুরেশি সম্প্রদায়কে নয়, মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে রাজ্যের কৃষকদেরও। কারণ প্রান্তিক জমির মালিক কৃষকেরা তাদের বৃদ্ধ বা দুগ্ধহীন গবাদি পশু বিক্রি করে নতুন পশু কেনেন। কুরেশিরা সেই বিক্রয়ের অন্যতম প্রধান অংশীদার।

এই পরিস্থিতিতে কুরেশি সম্প্রদায়ের দাবি, সরকার গত এক দশক ধরে গ্রামীণ এলাকায় কোনো পশুচিকিৎসক নিয়োগ করেনি। ফলে অনেক butcher বাধ্য হয়ে ঘরেই অবৈধভাবে পশু জবাই করছে। একদিকে এই ব্যবস্থা স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে গণহারে FIR দায়ের করছে।

অন্যদিকে, রাজ্য সরকার জুলাই ১৪ তারিখ ঘোষণা করেছে, তারা ‘বিফ স্মাগলিং’ ঠেকাতে নতুন আইন আনবে এবং গোরক্ষকদের বিরুদ্ধে চলমান মামলা প্রত্যাহার করা হবে। এমনকি কথিত "বিফ চোরাকারবারিদের" বিরুদ্ধে এখন MCOCA আইনের প্রয়োগের কথাও ভাবা হচ্ছে। এই পদক্ষেপকে কুরেশি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট নীতির অংশ বলেই মনে করছেন অনেকে।

লাতুরের অধিকারকর্মী জুনেদ আতার বলেন, "এই গোরক্ষক বাহিনীগুলো সংগঠিত, এক অঞ্চল থেকে অন্যত্র পশু পরিবহন হলেই তারা পুলিশকে নিয়ে হাজির হয়। এর মধ্যে অনেক সময় পুলিশও সম্পৃক্ত।" তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি লাতুরে একটি ঘটনার পর পুলিশের উপর চাপ সৃষ্টি করে গোরক্ষকদের বিরুদ্ধেই FIR দায়ের করাতে হয়েছে।

এই আন্দোলনের অর্থনৈতিক প্রভাব বিশাল। AIMIM-এর আইনজীবী ও কর্মী কাইজার প্যাটেল জানান, রাজ্যজুড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫,০০০ পশু জবাই হয়, যার মাসিক আর্থিক লেনদেন ৩০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। শুধুমাত্র ছত্রপতি সম্ভাজিনগরে একটি বেসরকারি সংস্থা প্রতিদিন ৮০০ মহিষ কিনে, যার মাসিক আর্থিক মূল্য ১০০ কোটি টাকারও বেশি।

এই পেশা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে কুরেশি সম্প্রদায়ের পাশাপাশি কৃষক, পরিবহন শ্রমিক, হোটেল-ক্যাটারিং ব্যবসায়ীসহ আরও অনেক গোষ্ঠী ক্ষতির মুখে পড়তে চলেছে। কুরেশিদের এই প্রতিবাদ এখন আর কেবল আত্মরক্ষার উপায় নয়, বরং এক মৌন কিন্তু তীব্র রাজনৈতিক বার্তা—তাদের অস্তিত্বের লড়াই।