আজকাল ওয়েবডেস্ক: একসময় যার পরিচয় ছিল ঠোঁটকাটা বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা, নির্ভীক টিপ্পনী আর আত্ম-উপহাসের সহজাত ক্ষমতার মধ্যে, আজ সেই ভারতীয় সমাজ যেন এক গভীর ‘হিউমার ডেফিসিট’-এর ফাঁদে আটকে পড়েছে। আগে যেখানে চায়ের দোকানে বন্ধুদের মধ্যে ঠাট্টা-মশকরা ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার, সেখানে আজ একটু রসিকতা করলেই তা অপমান, প্ররোচনা কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে পরিণত হচ্ছে। কমেডি ক্লাব থেকে শুরু করে ওয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বা ড্রইংরুমের ঠাট্টা – যেগুলো একসময় ছিল সমাজের হতাশা প্রশমনের ‘প্রেশার ভাল্ভ’ – আজ সেখানে কেউ কিছু বললে তা নিয়ে উঠছে মামলা, ট্রোল আর জেল হেফাজতের হুমকি।
কুনাল কামরা একবার বলেছিলেন, “ওরা মজা করাকেই অপরাধ বানিয়ে ফেলেছে।” আর আর.কে. লক্ষ্মণ তো বহু আগেই সতর্ক করেছিলেন, তাঁর ‘কমন ম্যান’ নীরব, কারণ সে এখন আর নির্ভয়ে হাসতে পারে না – কেউ না কেউ ‘অফেন্ড’ হয়ে যেতে পারে! ভার দাসের ‘টু ইন্ডিয়াস’ মনোলগ যখন তীব্র সমালোচনার শিকার হল, তখন তিনি টুইট করলেন, “ভারতীয়দের হাসির ক্ষমতা হারায়নি, ওটা একে একে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।” অপরদিকে, কঙ্গনা রানাউত বা সুধীর চৌধুরীর মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বেরা মত দেন যে কমেডির নামে দেশ বা সংস্কৃতিকে অপমান করার অধিকার নেই। ফলে এখনকার রসিকতা হতে হচ্ছে অত্যন্ত ‘ফিল্টারড’, সাবধানী ও ‘সেফ’। রাজনৈতিক বিদ্রুপ প্রায় বিলুপ্ত। খোঁচা মারা কমেডি মানেই যেন FIR, ট্রোলিং আর রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ।
আরও পড়ুন : ভয়ঙ্কর! ভারতীয় রাজনীতিতে অ্যাটম বোমা ফাটালেন রাহুল গান্ধী! নড়ে যেতে পারে গণতন্ত্রের ভিত
আরও করুণ বাস্তবতা হল, সামাজিক মাধ্যমেও হাসি আজ নিরুত্তাপ – রসবোধের জায়গায় এসেছে লাইক-শেয়ার আর অপমান-সংস্কৃতি। এককালের কড়া পাঞ্জাবি ঠাট্টা, তামিল ধাঁধা, মালয়ালি খোঁচা – আজকাল খুব একটা শোনা যায় না, হয়তো কোনো বৃদ্ধের ফোনে জমে থাকা পুরোনো ‘ফরোয়ার্ড’ হিসেবে। আরেকটা বড় পরিবর্তন ঘটেছে ভাষার ব্যবহারে। একসময়ের প্রাণবন্ত আঞ্চলিক রসবোধ হঠাৎ ‘হিংলিশ’ ভাষার গণ্ডিতে আটকে পড়েছে। সেটা যেমন নিরামিষ, তেমনই নিস্প্রাণ। এক সময়ের পাঞ্জাবি হাস্যরস আজ ফিসফিস করে বলার বিষয় হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো আশা শেষ হয়নি। ভারতীয় রসবোধ বেঁচে আছে গ্রামে-গঞ্জে, মোড়ের চায়ের দোকানে, ধাবায় বা হাটবারের বাজারে। সেখানকার রসিকতা এখনো প্রাণবন্ত, কাঁচা, কিন্তু খাঁটি। এখনো হাস্যরস গড়ে ওঠে মুখের ভাষায়, চোখের ইশারায়, পরম্পরাগত মৌখিক ধারায়।
তবু এই সত্য অস্বীকার করা যায় না – ভারতীয় সমাজ আজ ক্রমেই এমন এক বিন্দুর দিকে এগোচ্ছে, যেখানে মানুষ মুখে হাসলেও মনে আতঙ্ক, কেউ না কেউ কেমন যেন রাগ করবে! চিরচেনা আনন্দ, অকপট হাসি, আত্ম-উপহাস – সবই এখন সমাজের গা-জোয়ারি শালীনতার বিপক্ষে। অথচ এই রসবোধই ছিল সমাজের আত্মার পরিচয়। আজ যখন মানুষ মুখ খুলে ঠাট্টা করার আগেই ভাবতে হয় কী বলব, কোথায় বলব, কার সামনে বলব – তখন সেই সমাজ তার হাসি হারিয়েছে নয় শুধু, তার আত্মাকেও কিছুটা হারিয়েছে।
আর সে আত্মা ফিরিয়ে আনতে হলে চাই আরও সহিষ্ণুতা, রাজনৈতিক অতিসংবেদনশীলতা কাটিয়ে সমাজের ভিতরকার বৈপরীত্যগুলোকে স্বীকার করার সাহস। কারণ, যেখানে মানুষের হাসির স্বাধীনতা নেই, সেখানে ব্যঙ্গ নয় শুধু – মনুষ্যত্বও হারিয়ে যায় নিঃশব্দে। বর্তমান ভারতীয় সমাজে রসিকতা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের প্রতি অসহিষ্ণুতার যে প্রবণতা দেখা দিচ্ছে, তা এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়। আগে যেটা নিছক মজা ছিল, এখন তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিযুক্ত হচ্ছে। সমালোচনার সুরে বলা একটি ঠাট্টাও এখন রাষ্ট্রদ্রোহ, জাতীয় অপমান কিংবা সংস্কৃতিবিরোধিতার মোড়কে আদালতের দরজায় পৌঁছে যাচ্ছে। স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানদের অনুষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে, মামলা দায়ের হচ্ছে, ট্রোলিং ও মৃত্যুর হুমকি দেওয়া হচ্ছে – এই প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার সমালোচনা এখন হাস্যরসের মধ্য দিয়েও নিষিদ্ধের তালিকায় চলে যাচ্ছে।
চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার অন্যতম মাধ্যম ছিল ব্যঙ্গচিত্র, কমেডি, নাট্যরূপ বা সোশ্যাল মিডিয়ায় রসিকতা – আজ সেগুলোর প্রতিটিই নজরদারির আওতায়। একটা সাধারণ মত প্রকাশকেও ‘দেশবিরোধী’ তকমা দিয়ে থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এর ফলে সমাজে একটা ‘আত্মনির্ভর ভয়ের সংস্কৃতি’ গড়ে উঠছে – যেখানে মানুষ নিজের ভেতরের কথাও প্রকাশ করতে সাহস পায় না। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ একটি সুস্থ গণতন্ত্রের অপরিহার্য অঙ্গ – সেটাই যখন প্রশ্নের মুখে পড়ে, তখন বোঝা যায়, সমাজ শুধু রসিকতা হারাচ্ছে না, গণতান্ত্রিক পরিসরটাও সংকুচিত হয়ে আসছে। এই প্রবণতা একটি বিপজ্জনক নিঃশব্দ নিপীড়নের পথ সুগম করছে।
