আজকাল ওয়েবডেস্ক: আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ভারতীয় পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ৫০% পর্যন্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর ভারত সরকার এটিকে "চরম দুর্ভাগ্যজনক" বলে ঘোষণা করেছে। ট্রাম্প এই শুল্ক আরোপের পেছনে দুইটি যুক্তি দিয়েছেন: প্রথমত, ভারতের বিদ্যমান শুল্কের পাল্টা হিসেবে ২৫% "reciprocal" হার, এবং দ্বিতীয়ত, রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি বন্ধ না করার কারণে ২৫% "penalty" হারে অতিরিক্ত শুল্ক। ভারত স্পষ্ট জানিয়েছে যে, অনেক দেশই নিজেদের জাতীয় স্বার্থে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করছে এবং শুধুমাত্র ভারতকে শাস্তি দেওয়া ন্যায়সঙ্গত নয়।

শ্রমনির্ভর শিল্পে বড় ধাক্কা

Global Trade Research Initiative (GTRI)-র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই নতুন শুল্ক কাঠামো সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে ভারতের শ্রমনির্ভর উৎপাদন শিল্পগুলিতে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মোট ট্যারিফ ৬০% পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাতে পারে। এর ফলে মার্কিন বাজারে ভারতীয় পণ্য অচল হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছে রপ্তানিকারক মহল। বিশেষ করে বস্ত্রশিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বোনা পোশাকের ওপর ট্যারিফ ১৩.৯% থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৩.৯% এবং মাকানো পোশাকের ওপর ১০.৩% থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০.৩%। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দুই ধরনের পোশাকের ক্ষেত্রে ভারতের সর্ববৃহৎ রপ্তানি বাজার – মোট রপ্তানির ৩০% এরও বেশি যুক্তরাষ্ট্রেই যায়। 'মেড-আপ' টেক্সটাইল পণ্যের ক্ষেত্রেও বড় ধাক্কা এসেছে। পূর্বে যেখানে এই পণ্যের উপর ৯% হারে ট্যারিফ ছিল, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯%-এ। FY 2024-25 সালে ভারত $৩ বিলিয়ন মূল্যের এই পণ্য আমেরিকায় রপ্তানি করেছিল, যা মোট রপ্তানির ৪৮.৪%।

অন্য দেশগুলি পাচ্ছে সুবিধা

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের, ভিয়েতনামের এবং কম্বোডিয়ার পণ্য মার্কিন বাজারে ভারতের বিকল্প হিসেবে উঠে আসবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এদের ওপর ট্যারিফ হার যথাক্রমে ২০%, ২০% এবং ১৯%, যা ভারতের তুলনায় অনেক কম। কার্পেট শিল্প, যা ভারত থেকে আমেরিকায় রপ্তানির ৫৮.৬% সরবরাহ করে, তাতেও প্রবল প্রভাব পড়বে। ভারতের মোট $১.২ বিলিয়ন মূল্যের কার্পেট রপ্তানি হুমকির মুখে পড়েছে, কারণ ট্যারিফ ২.৯% থেকে বেড়ে হয়েছে ৫২.৯%। অন্যদিকে, তুরস্ক, মিশর এবং মেক্সিকো থেকে এই পণ্যে ট্যারিফ হার যথাক্রমে ১৫%, ১০% ও ০% (USMCA চুক্তির অধীনে)।

রত্ন ও গয়না শিল্পে ব্যাপক প্রভাব

ভারতের হীরা ও স্বর্ণ শিল্পও চরম বিপদের মুখে। আগে যেখানে এই শিল্পের ওপর মার্কিন ট্যারিফ ছিল ২.১%, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২.১%। FY 2024-25-এ ভারত $১০ বিলিয়ন মূল্যের এই পণ্য আমেরিকায় রপ্তানি করেছিল – যা এই খাতের মোট রপ্তানির ৪০%। বেশ কিছু শিল্পপতি ইতিমধ্যে উত্পাদন ঘাঁটি সংযুক্ত আরব আমিরাত বা মেক্সিকোতে সরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছেন।

আরো পড়ুন: টাকা তুলতে ব্যাঙ্কে ঢুকেই ক্যাশিয়ারের সামনে ঝুঁকলেন মহিলা, তারপর যা দেখা গেল! মূর্ছা গেল ক্যাশিয়ার! দাবানলের মতো ছড়াচ্ছে সেই ভিডিও

চিংড়ি ও সামুদ্রিক খাদ্য খাতে ধাক্কা

ভারতের চিংড়ি রপ্তানির ৩২.৪% মার্কিন বাজারে যায়, যেখানে এতদিন কোনও ট্যারিফ ছিল না। এখন তা একলাফে ৫০% হয়ে গেছে। এই খাতে ভারতের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী থাইল্যান্ড (১৯%), ভিয়েতনাম (২০%) ও ইন্দোনেশিয়া (১৯%) – যাদের ওপর শুল্ক অনেক কম।

আসবাব শিল্পেও ধস

ভারতের আসবাব, বেডিং এবং ম্যাট্রেস শিল্প FY 2024-25-এ $১.১ বিলিয়ন রপ্তানি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রে, যা এই খাতের মোট রপ্তানির ৪৫%। এই শিল্পের ট্যারিফ ২.৩% থেকে বেড়ে ৫২.৩% হয়েছে।

চুক্তির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

ভারত ও আমেরিকার মধ্যে ইতিমধ্যেই পাঁচ দফা বাণিজ্য আলোচনা হয়েছে এবং আরেক দফা এই মাসেই নির্ধারিত রয়েছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের এই রকম একতরফা সিদ্ধান্ত ও ঘন ঘন অবস্থান বদলের কারণে আলোচনা ফলপ্রসূ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এম.এস. স্বামীনাথন শতবার্ষিক সম্মেলনে বলেন, “ভারত কখনোই কৃষকের স্বার্থে আপস করবে না, যদিও এর জন্য আমাকেই ব্যক্তিগতভাবে মূল্য চোকাতে হয়।” এই বক্তব্যে ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, আমেরিকার কৃষি বাজার উন্মুক্ত করার চাপে ভারত নত হবে না।

সমাধানের সম্ভাবনা

GTRI-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন বাণিজ্য আধিকারিক অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, “যদি এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, তাহলে ভারতীয় রপ্তানিকারকদের জন্য মার্কিন বাজার সম্পূর্ণভাবে অচল হয়ে পড়বে।” তবে ভারত-যুক্তরাজ্য বাণিজ্য চুক্তি, যেখানে মাছ ও সামুদ্রিক পণ্যের ওপর শুল্ক বাতিল হয়েছে, সেখানে নতুন বাজার তৈরির সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। বর্তমানে ভারত এক কঠিন অবস্থায় রয়েছে – একদিকে জাতীয় স্বার্থে রাশিয়ার সাথে জ্বালানি বাণিজ্য বজায় রাখা, অন্যদিকে মার্কিন বাজারে প্রবেশাধিকার হারানোর ঝুঁকি। ভারতীয় রপ্তানিকারকরা এখন তাকিয়ে আছেন আগামী ২০ দিনের দিকে – যদি ট্রাম্প তাঁর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করেন, তাহলে ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হতে চলেছে এই চরম ট্যারিফ, যার ফলে ভারতের বহু শ্রমনির্ভর খাতের অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে।