আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারতের প্রাক্তন উপ-প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আডবানীর জন্মদিনে প্রশংসা করে মন্তব্য করে নতুন বিতর্কে জড়ালেন কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর। তাঁর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে তিনি আডবানীর রাজনৈতিক জীবনের নানা বিতর্ক সত্ত্বেও তাঁকে “একজন সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়ক” হিসেবে দেখছেন। তবে থারুরের এই মন্তব্য থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে কংগ্রেস নেতৃত্ব।
শনিবার থারুর তাঁর এক্স অ্যাকাউন্টে আডবানীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেছেন— “আডবানীজির নিরলস জনসেবার মনোভাব, তাঁর বিনয় ও সৌজন্য, এবং আধুনিক ভারতের গঠনে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়।” সঙ্গে তিনি একটি পুরনো ছবি পোস্ট করেন, যেখানে তাঁকে অ্যাডভানির সঙ্গে দেখা যাচ্ছে।
এই মন্তব্যের পরপরই থারুরের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে। আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ে লিখেছেন, “আডবানীজি দেশের মধ্যে ঘৃণার বীজ বপন করেছিলেন— এটাকে জনসেবা বলা যায় না।”
প্রত্যুত্তরে থারুর বলেন, “একজন মানুষের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের মূল্যায়ন কেবল একটি অধ্যায়ের ভিত্তিতে করা অন্যায়।” তিনি আরও যুক্তি দেন, “যেমন নেহরুজির সমগ্র জীবনকে কেবল চীন যুদ্ধের পরাজয়ের ভিত্তিতে বিচার করা যায় না, কিংবা ইন্দিরা গান্ধীর জীবনকে শুধু জরুরি অবস্থার মাধ্যমে দেখা যায় না, তেমনি আডবানীজিকেও কেবল রথযাত্রা বা বাবরি মসজিদ ঘটনার মাধ্যমে বিচার করা ঠিক নয়।”
তবে ইতিহাসবিদ স. ইরফান হাবিব এই তুলনার সঙ্গে তীব্র আপত্তি জানান। তাঁর বক্তব্য, “চীন যুদ্ধ বা জরুরি অবস্থা ইতিহাসের ভুল থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছি। কিন্তু আডবানীর বিভাজনমূলক রাজনীতি আজও সমাজে বিষ ছড়াচ্ছে, যার ফল আমরা প্রতিদিন দেখছি।”
লেখিকা ও সমাজকর্মী নন্দিনী কে. ওজা লিখেছেন, “১৯৯০ সালে আডবানী যখন রথযাত্রা শুরু করেন, তখন আমি ছিলাম এক তরুণী, এক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের স্বপ্ন দেখতাম। সেই রথযাত্রা শেষ হয়েছিল বাবরি মসজিদের ধ্বংসে, ঘৃণার রাজনীতিতে, আর আমাদের সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল।”
বিজেপি নেতা হিসেবে আডবানীর ১৯৯০ সালের রথযাত্রা ছিল ভারতীয় রাজনীতির এক টার্নিং পয়েন্ট। সেখান থেকেই শুরু হয় হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান, যা ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনায় পরিণত হয়। সুপ্রিম কোর্ট পরে সেই ভাঙনকে অবৈধ ঘোষণা করলেও জমিটি মন্দির ট্রাস্টকে দিয়ে দেয়। আজ সেই স্থানে নির্মিত হয়েছে রাম মন্দির।
কংগ্রেসের মিডিয়া ও প্রচার বিভাগের চেয়ারম্যান পবন খেরা বলেন, “ড. শশী থারুর সর্বদা নিজের ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস তাঁর এই বক্তব্য থেকে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের আলাদা করছে। তবে কংগ্রেসের সাংসদ ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েও তিনি নিজের মতামত রাখতে পারেন— সেটাই আমাদের দলের উদার গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতিফলন।”
পরে আসামের এক কংগ্রেস মিডিয়া কোঅর্ডিনেটর আডবানীর রাজনীতির ফলে সংঘটিত দাঙ্গাগুলিতে কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার হিসাব তুলে ধরেন। সেই পোস্টের উত্তরে থারুর লেখেন, “আমি আডবানীর উত্তরাধিকার সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। আমার ২০০১ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ''Riot''-ই তার সাক্ষী, যা ১৯৮৯ সালের রাম শিলা পূজন চলাকালীন এক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে লেখা।”
থারুরের মন্তব্যে কংগ্রেসের ভিতরে আপাতত প্রকাশ্য দ্বিধা দেখা দিয়েছে— একদিকে দলের উদার মতপ্রকাশের ঐতিহ্য, অন্যদিকে আডবানীর নেতৃত্বে হিন্দুত্ব রাজনীতির যে ধারা ভারতকে গভীরভাবে বিভক্ত করেছে, তার বিরুদ্ধে দলের ঐতিহাসিক অবস্থান। এই দুইয়ের টানাপোড়েনে থারুরের “রাষ্ট্রনায়ক” প্রশংসা এখন কংগ্রেসের জন্য এক অস্বস্তিকর অধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
