আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিহারের সমষ্টিপুর জেলার সিংঘিয়া ঘাটে সদ্যসমাপ্ত নাগ পঞ্চমী মেলায় ফিরে এল সেই পুরনো দৃশ্য—হাতে, গলায়, মাথায় জড়ানো জীবন্ত সাপ। কয়েকশো বছর ধরে চলে আসা এই রীতিতে এবারও অংশ নিয়েছে হাজার হাজার ভক্ত, যারা মা ভাগবতী ও স্থানীয় সাপদেবী বিষহরীর কৃপা প্রার্থনা করতে সাপ নিয়ে হাজির হন বুড়ি গণ্ডক নদীর তীরে। ছোট শিশু থেকে বৃদ্ধা, সকলের হাতে দেখা গেছে কোবরা বা অন্য প্রজাতির সাপ—কখনো কাঠের লাঠিতে পেঁচানো, কখনো কাঁধে বসানো। কেউ কেউ আবার মুখে সাপ ধরে রাস্তায় হাঁটেন, যা দেখে অনেকেই শিউরে ওঠেন। ইনস্টাগ্রামে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, উৎসব যেন এক বিশাল সর্পমিছিল, যেখানে সাপ শুধু পূজার সামগ্রী নয়, বরং বিশ্বাস ও সাহসের প্রতীক।

তবে এ বছরের নাগ পঞ্চমী উৎসব ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। Brut India-র ভিডিওতে উল্লেখ করা হয়েছে যে বহু সাপ উৎসবের আগেই ধরা হয় এবং বিষদন্ত তুলে নেওয়া হয়—এক নিষিদ্ধ ও নির্মম পদ্ধতি, যা ভারতীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। যদিও পরে সাপগুলো বনাঞ্চলে ছেড়ে দেওয়া হয়, কিন্তু পরিবেশবিদরা বলছেন, বিষদন্তহীন সাপ প্রকৃতিতে টিকে থাকতে পারে না, ফলে এই প্রথা পরোক্ষে প্রাণহানি ঘটাচ্ছে। অনেকেই এই ধরনের আচরণকে 'আধ্যাত্মিকতার নামে নিষ্ঠুরতা' বলে অভিহিত করেছেন। এক ব্যবহারকারী লেখেন, “সত্যিকারের ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা কখনোই প্রাণীকে কষ্ট দিয়ে প্রকাশ পায় না।” অপরজন মন্তব্য করেন, “সাপের গায়ে পুজোর প্রলেপ লাগিয়ে যা করা হচ্ছে, তা আদতে মানবিক নয়, বরং এক প্রকার কুসংস্কার।” অন্য এক ব্যক্তি লেখেন, “Hum Angrej Se Nahi, Angrej Humse Azad Huye”—এ মন্তব্যের মাধ্যমে হয়তো তিনি অতীতের ব্রিটিশ উপনিবেশের তুলনায় আজকের সমাজের পশ্চাৎপদতার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

 আরও পড়ুন: "তুমি কামের ফাঁদে পড়েছ"! নৈতিক অধঃপতনের অভিযোগে বরখাস্ত ৯ 'সন্নাসীকে' জানালো মঠ কর্তৃপক্ষ!

তবুও, ভক্তরা বলছেন, এই প্রথার সঙ্গে তাঁদের আবেগ ও পারিবারিক ইতিহাস জড়িয়ে আছে। সিংঘিয়া ও আশেপাশের অঞ্চলের বহু পরিবার পুরুষানুক্রমে এই উৎসবে অংশ নিচ্ছেন। কোনো সন্তান জন্ম নিলে, রোগমুক্তি ঘটলে বা পরিবারে শুভ ঘটনা ঘটলে, তাঁরা মা বিষহরীর কৃপা বলে বিশ্বাস করেন। নারীরা গহ্বরের ভিতরে বসে সাপ দেবীর সামনে নারকেল, লাড্ডু, সিঁদুর, ও দুধ উৎসর্গ করেন। এই মেলাকে ঘিরে একটি গ্রামীণ মেলা বসে—যেখানে নাগিন নাচ, সাপুড়ে খেলা, খেলনা বিক্রি, স্থানীয় খাদ্যদ্রব্যের স্টল, এমনকি লোকগান পরিবেশনারও আয়োজন হয়। এই উৎসব শুধু ধর্মীয় নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মিলনের এক বিরাট প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। অনেকের কাছে এটি প্রতিবছরের সবচেয়ে বড় উৎসব, যেখানে ভক্তি ও বিনোদন একসূত্রে বাঁধা।

অন্যদিকে, মহারাষ্ট্রের সাংলি জেলার বাত্তিশ শিরালার প্রসিদ্ধ সাপ মেলা পুনরুজ্জীবিত করার পরিকল্পনা ঘিরেও বিতর্ক চলছে। বিজেপি বিধায়ক সত্যজিৎ দেশমুখ এই ঐতিহাসিক রীতিকে পুনরায় চালুর দাবিতে বিধানসভায় আওয়াজ তোলেন। রাজ্যের বনমন্ত্রী গণেশ নায়েক জানিয়েছেন, এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে পরিবেশবাদী এবং প্রাণী অধিকার কর্মীরা এই পদক্ষেপকে “আইন ও সহানুভূতির পরিপন্থী” বলে অভিহিত করেছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কোবরা ভারতীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের সিডিউল-১ অন্তর্ভুক্ত প্রাণী। এদের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করাকে সমর্থন না করে বিকল্পভাবে মাটির বা কাঠের তৈরি সাপ দিয়ে রীতিগুলি পালন করার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। পেটা (PETA)-ও ২০১৬ সালে এমনই আহ্বান জানিয়েছিল, যদিও এ বছর এখনো পর্যন্ত কোনও নতুন বিবৃতি প্রকাশ করেনি।

সব মিলিয়ে, নাগ পঞ্চমী এখন কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এক সামাজিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। একদিকে সংস্কার ও বিশ্বাস, অন্যদিকে বিজ্ঞান, পরিবেশ এবং সহানুভূতির মধ্যে দোদুল্যমান এই মেলায় উঠে আসছে আধুনিক ভারতের ধর্মীয় চেতনা বনাম মানবিক দায়বদ্ধতার এক জটিল দ্বন্দ্ব।