আজকাল ওয়েবডেস্ক: অবিশ্বাস্য সহনশীলতার এক চোখধাঁধানো প্রদর্শনীতে মণিপুরের ঘন বন থেকে উপগ্রহ-ট্যাগ লাগানো তিনটি বাজপাখি আবারও প্রমাণ করল কেন তারা পৃথিবীর অন্যতম দুর্দান্ত পরিযায়ী পাখি। মাত্র ১৫০ গ্রাম ওজনের ছোট্ট দেহে হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার যে অসামান্য ক্ষমতা, তা এবছরও বিজ্ঞানীদের তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ‘আপাতাং’, ‘আলং’ ও ‘অহু’—এই তিন ডানাওয়ালা যোদ্ধার ভ্রমণ আবারও আন্তর্জাতিক গবেষকদের নজর কেড়েছে।
সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে কমলা চিহ্নিত আপাতাং। সারাবিশ্বের পক্ষীবিজ্ঞানীদের অবাক করে দিয়ে সে মাত্র ছয় দিন আট ঘন্টায় টানা ৬,১০০ কিলোমিটার উড়ে পৌঁছেছে কেনিয়ায়। উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে শুরু করে সমগ্র উপদ্বীপ অতিক্রম করে, বিশাল আরব সাগর পেরিয়ে, আফ্রিকার হর্ন অঞ্চল ছুঁয়ে অবশেষে তার অবতরণ—এ এক অনবদ্য দীর্ঘ-উড়ানের রেকর্ড। একটি ছোট র্যা প্টর পাখির পক্ষে এত দীর্ঘ, নিরবচ্ছিন্ন ও অক্লান্ত ভ্রমণ সত্যিই বিস্ময়কর। গবেষকরা জানিয়েছেন, আপাতাং-এর উড়ান বাজপাখির দীর্ঘতম নন-স্টপ পরিযায়ী যাত্রাগুলোর একটি হিসেবে নথিভুক্ত হতে চলেছে।
এর ঠিক পিছনেই রয়েছে সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য, হলুদ ট্যাগ লাগানো আলং। প্রথমবারের মতো পরিযানে অংশ নিয়েও সে দেখিয়েছে অসাধারণ ধৈর্য ও অভিযোজনক্ষমতা। মোট ৫,৬০০ কিলোমিটার পথ সে পাড়ি দিয়েছে ছয় দিন চৌদ্দ ঘন্টায়। রাস্তায় তারা তেলেঙ্গানায় এক রাতের ক্ষুদ্র বিরতি এবং মহারাষ্ট্রে প্রায় তিন ঘণ্টার বিশ্রাম শেষে পুনরায় আকাশে ভেসে ওঠে। এরপর আরব সাগরের কঠিন ট্রান্সওশানিক পথ অতিক্রম করে শেষমেশ কেনিয়ার আকাশসীমায় প্রবেশ করে। আলংয়ের এই যাত্রা তরুণ পরিযায়ী পাখির অবিশ্বাস্য সক্ষমতার আরেক অনন্য প্রমাণ।
লাল চিহ্নিত অহু এবার একটু ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। অন্য দু’জনের তুলনায় সে কিছুটা উত্তরে উঠে পশ্চিম বাংলাদেশে স্বল্প বিরতি নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে। তারপর আরব সাগরের ওপরে লক্ষ কিলোমিটার আকাশপথে ছুটে যায়। প্রায় ৫,১০০ কিলোমিটার পথ সে অতিক্রম করেছে মাত্র পাঁচ দিন চৌদ্দ ঘণ্টায়। বর্তমানে অহু অবস্থান করছে সোমালিয়ার উত্তর প্রান্তে। ধারণা করা হচ্ছে, সেখান থেকে সে তার সঙ্গীদের সাথে মিলিত হয়ে কেনিয়ার সুবিখ্যাত সাভান্না অঞ্চল— ৎসাভো ন্যাশনাল পার্ক—এর দিকে রওনা দেবে, যা বহু বছর ধরে বাজপাখি পরিচিত বিশ্রামস্থল।
প্রতি বছর এই পরিযায়ী যাত্রা প্রমাণ করে কেন বাজপাখির অন্য নাম—“ক্ষুদে দীর্ঘপথিক”। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে আফ্রিকার দূর প্রান্তে পৌঁছানোর এই রোমাঞ্চকর অভিযান শুধু দুই মহাদেশকে নয়, বিভিন্ন দেশ, সমুদ্র, মরুভূমি ও বিস্তীর্ণ অনাবাদী ভূখণ্ডকে এক সুদৃশ্য পরিযায়ী রুটে যুক্ত করে।
এই সামনে এগোনোর শক্তি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয় প্রকৃতি সংরক্ষণের নতুন বার্তা। বিজ্ঞানী, পক্ষিবিদ ও পরিবেশবিদদের মতে, বাজপাখির এই মহাযাত্রা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—পরিযায়ী পাখিদের সুরক্ষা মানেই এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে ছড়িয়ে থাকা পুরো প্রতিবেশব্যবস্থা রক্ষা করা। তাদের নিরাপদ পথ, বিশ্রামস্থল এবং বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করা আজ বিশ্বব্যাপী এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
