সূর্যেরও নিজস্ব আবহাওয়া রয়েছে, আর তার অন্যতম অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হল ‘সোলার রেইন’ বা সৌর বৃষ্টি — যা সূর্যের বায়ুমণ্ডলে সৌর জ্বালার সময় ঘটে। তবে এই বৃষ্টি কিন্তু জলের নয়; এটি হচ্ছে প্লাজমার বৃষ্টি। প্লাজমা এমন এক অবস্থা যেখানে গ্যাস এতটাই উত্তপ্ত হয় যে পরমাণুগুলো তাদের ইলেকট্রন হারিয়ে ফেলে। এই উত্তপ্ত গ্যাস ঠান্ডা হয়ে ঘন ক্লাস্টারে রূপ নেয় এবং সূর্যের পৃষ্ঠের দিকে ঝরে পড়ে।
2
10
বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেছেন, সৌর জ্বালার সময় এই ‘করোনাল রেইন’ বা করোনার বৃষ্টি খুব দ্রুত তৈরি হয়, তারপর সূর্যের চৌম্বক আর্চ বরাবর দৌড়ে যায় ছোট ছোট আলোকিত বিন্দুর মতো। এই গতি ব্যাখ্যা করা দীর্ঘদিন ধরেই কঠিন ছিল, কারণ প্রচলিত মডেলগুলো ধরে নেয় যে সূর্যের করোনা — অর্থাৎ দৃশ্যমান পৃষ্ঠের উপরের গরম, স্বল্পঘন স্তর — একটি নির্দিষ্ট রাসায়নিক গঠনে স্থির থাকে।
3
10
কিন্তু বাস্তবে সৌর জ্বালার সময়, এই করোনাল লুপগুলোতে গরম প্লাজমা ভরে যায়, যা পরে বিকিরণের মাধ্যমে ঠান্ডা হয় এবং কিছু অংশ ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সংক্ষিপ্ত শক্তিবিস্ফোরণ বা ‘ইম্পালসিভ হিটিং’ এর ফলে বৃষ্টি অনেক দ্রুত গঠিত হয়, যা স্থির উত্তাপের মডেল দিয়ে বোঝানো যায় না।
4
10
এই রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাস্ট্রোনমির গবেষক লুক ফুশিমি বেনাভিৎস। তিনি উন্নত পদার্থবিদ্যা সংযোজিত নতুন কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করেছেন, যেখানে প্লাজমার রাসায়নিক গঠনকে সময় ও স্থানের সঙ্গে পরিবর্তনশীল ধরা হয়েছে। তাঁর গবেষণায় দেখা গেছে, যদি লোহার, সিলিকনের, এবং ম্যাগনেশিয়ামের মতো উপাদানের ঘনত্ব লুপের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন হয়, তবে তা ঠান্ডা হওয়ার হারকে উল্টে দিতে পারে। লুপের শীর্ষে এসব উপাদান বেশি জমলে বিকিরণ বেড়ে যায়, তাপমাত্রা দ্রুত কমে এবং ঘনীভবন ঘটে—ফলে গঠিত হয় ঘন ঠান্ডা ফোঁটা, যেগুলোকেই আমরা সৌর বৃষ্টি হিসেবে দেখি।
5
10
বেনাভিৎস বলেন, “বর্তমান মডেলগুলো ধরে নেয় যে সূর্যের করোনায় সব উপাদান স্থির অনুপাতে ছড়ানো থাকে, কিন্তু বাস্তবে তা নয়।” এই অনুমানের পরিবর্তনের ফলে তাঁর মডেলের ফলাফল বাস্তব পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মিলে গেছে।
6
10
এই মডেল দেখায়, সৌর জ্বালার সময় প্রবাহিত প্লাজমা নিম্ন প্রথম আয়নায়ন শক্তি সম্পন্ন উপাদানগুলোকে লুপের শীর্ষে ঠেলে দেয়। এতে ঐ অঞ্চলে বিকিরণ হঠাৎ বেড়ে যায়, এবং সেখানে শুরু হয় এক ধরনের ‘রানঅ্যাওয়ে কুলিং’ যা বৃষ্টির জন্ম দেয়।
7
10
‘ফার্স্ট আয়নাইজেশন পটেনশিয়াল’ প্রভাবটি বোঝায় কেন করোনায় নিম্ন উপাদানগুলো ফটোস্ফিয়ারের তুলনায় বেশি পরিমাণে থাকে। এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ক্রোমোস্ফিয়ারে উৎপন্ন আলফভেন তরঙ্গ আয়ন ও নিরপেক্ষ কণাকে আলাদা করে দেয়, ফলে উপরের স্তরে ওঠা প্লাজমার গঠন পরিবর্তিত হয়।
8
10
ফ্লেয়ারের সময় গরম ক্রোমোস্ফেরিক পদার্থ চৌম্বক ক্ষেত্র বরাবর উপরের দিকে প্রবাহিত হয়, এবং তাতে নিম্ন উপাদান সমৃদ্ধ অংশগুলো লুপে মিশে যায়। এই ভিন্নতাই লুপের বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তি বিকিরণের দক্ষতা বদলে দেয়। লুপের শীর্ষে সামান্য অতিরিক্ত নিম্ন ঘনত্বও সেখানে বিকিরণ বাড়িয়ে দেয়, দ্রুত ঠান্ডা হওয়া ও ঘনীভবন ঘটায়।
9
10
২০১৬ সালের উচ্চ রেজোলিউশনের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এক এম-শ্রেণির ফ্লেয়ারের শীতল পর্যায়ে প্লাজমা সূক্ষ্ম সুতার মতো নেমে আসছে — যা সৌর বৃষ্টির প্রত্যক্ষ প্রমাণ। আরও কিছু তথ্য জানিয়েছে, স্বল্পস্থায়ী শক্তিবিস্ফোরণই এই ঘনীভবনের বীজ রোপণ করে, যা পরে বৃষ্টিতে রূপ নেয়।
10
10
নতুন গবেষণা তাই দেখাচ্ছে, সৌর বৃষ্টি কেবল তাপীয় প্রক্রিয়ার ফল নয়; বরং এটি সূর্যের রাসায়নিক পরিবর্তন, চৌম্বক ক্ষেত্র ও তরঙ্গগত শক্তির জটিল মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল — যা সূর্যের নিজস্ব ‘আবহাওয়া ব্যবস্থা’র এক বিস্ময়কর নিদর্শন।