আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারত শিল্পায়নের প্রয়োজনীয় ধাপ অতিক্রম না করেই দ্রুত পুঁজিবাদী উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করছে—এভাবে “স্পিড রানিং ক্যাপিটালিজম”-এর ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে দেশ। Frontline–কে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দক্ষিণ কোরিয়ান অর্থনীতিবিদ হা-জুন চ্যাং ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক পথচলাকে "গভীরভাবে অসম্পূর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ" বলে মন্তব্য করেছেন। তার মতে, শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে না তুলে সরাসরি পরিষেবা খাতে ঝাঁপ দেওয়া শুধু বিভ্রান্তিকর ধারণাই নয়—বরং দীর্ঘমেয়াদে ভারতের জন্য বিপজ্জনক।


শিল্পখাতের অনুপস্থিতি

চ্যাং স্পষ্টভাবে বলেন, “ভারত আসলে প্রকৃত অর্থে শিল্পায়নের পর্যায়ে পৌঁছাতেই পারেনি।”
ঐতিহাসিকভাবে ভারতের মোট দেশজ উৎপাদনে (GDP) উৎপাদন বা ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান অত্যন্ত সীমিত—বিগত কয়েক দশকে তা ১২–১৩ শতাংশের মধ্যে সীমিত থেকেছে। অথচ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চিন, ভিয়েতনাম এবং এমনকি কিছু আফ্রিকান দেশ শিল্পখাতকে প্রধান ভিত্তিতে দাঁড় করিয়েই মধ্যম আয়ের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসেছে। চ্যাং ব্যাখ্যা করেন, শিল্পায়ন শুধুমাত্র উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়—এটি কৃষি থেকে শ্রমিকদের উচ্চ উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে স্থানান্তর করে। এর ফলে মজুরি বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন, উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতি তৈরি হয়।


এআই যুগে পরিষেবা-নির্ভর অর্থনীতির ঝুঁকি

ভারতীয় অর্থনীতি যেখানে তথ্যপ্রযুক্তি, কলসেন্টার, আউটসোর্স কোডিং বা স্বল্পমূল্যের পরিষেবা খাতে নির্ভরশীল, সেখানেই চ্যাং সতর্ক করেন যে এই ক্ষেত্রগুলো সবচেয়ে দ্রুতগতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) দখল করে নেবে। তার ভাষায়, “যে পরিষেবা খাতকে কেন্দ্র করে ভারত গর্ব করছে, সেটিই AI–এর সবচেয়ে বড় শিকার হবে।” অন্যদিকে, শক্তিশালী শিল্পভিত্তি থাকা দেশগুলো এআই–কে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে পারলেও, শিল্পায়ন ছাড়া দেশগুলো বরং বিপুল কর্মসংস্থান হারানোর আশঙ্কায় পড়বে।


ভারতের কর্পোরেট অভিজাতদের মানসিকতার সমালোচনা

হা-জুন চ্যাং ভারতের শিল্পবিমুখ অর্থনৈতিক চরিত্রের প্রধান কারণ হিসেবে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার পাশাপাশি কর্পোরেট ও আর্থিক অভিজাতদের আচরণের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ভারতের শিল্পপতিদের বড় একটি অংশ স্বল্পমেয়াদি মুনাফার দিকে ঝুঁকে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি শিল্প বিনিয়োগ, গবেষণা, উদ্ভাবন এবং শ্রমিক দক্ষতা বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এমন প্রবণতা ভারতকে উৎপাদনমুখী অর্থনীতি নয়, বরং আর্থিক জল্পনা-কল্পনা চালিত "শেয়ারহোল্ডার পুঁজিবাদ"-এর পথে ঠেলে রাখছে।

সমাধান: উন্নয়নমূলক রাষ্ট্র এবং সক্রিয় শিল্পনীতি

এই পরিস্থিতিতে চ্যাং একটি উন্নয়নমূলক রাষ্ট্র (Developmental State) মডেলের পরামর্শ দেন—যেখানে সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, ভর্তুকি, সুরক্ষা নীতি, এবং সক্রিয় শিল্প মনোযোগ দেবে। প্রয়োজনে কিছু সময়ের জন্য আর্থিক নিয়ন্ত্রণ বা Financial Repression–এর মাধ্যমেও শিল্পবিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

তার মতে: “শিল্পনীতি ছাড়া কোনও দেশ টেকসই অর্থনৈতিক শক্তি হতে পারে না। ভারত যদি পথ না বদলায়, তাহলে ভবিষ্যতের প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে সে অন্যতম বৃহৎ ক্ষতিগ্রস্ত দেশে পরিণত হবে।”

হা-জুন চ্যাংয়ের এই সাক্ষাৎকার শুধু অর্থনীতিবিদদের আলোচনার বিষয় নয়, বরং ভারতের উন্নয়নের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক গভীর সতর্কবার্তা। প্রযুক্তি, পুঁজিবাদ এবং বিশ্বায়নের দ্রুতগতির দৌড়ে অংশ নেওয়ার আগে ভারতের কাছে এখন মূল প্রশ্ন— শিল্পভিত্তিক কাঠামো গড়ে অর্থনৈতিক স্থিতি নিশ্চিত করা হবে, নাকি পরিষেবা নির্ভর অস্থির উন্নয়নের পথে ঝুঁকি নেওয়া হবে?

ভারতের আগামী অর্থনৈতিক নীতি ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এই প্রশ্নের উত্তর নির্ধারণ করবে।