লক্ষ্মীকান্তপুর, বনগাঁ, ক্যানিং লোকাল মানেই হাজারও গল্প, দু'চোখে স্বপ্ন নিয়ে শহরে আসা, কাজ শেষে আবার ফিরে যাওয়া। সেই সমস্ত মানুষের গল্পই যেন ভালবাসার নিপাট বুননে উঠে এল 'লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল' ছবিতে। অভিনয় থেকে ক্যামেরার কাজ, গান থেকে চিত্রনাট্য- সব মিলিয়ে কেমন হল রামকমল মুখোপাধ্যায় পরিচালিত দ্বিতীয় বাংলা ছবি? দেখলেন শুভস্মিতা কাঞ্জি

অফিস বেরোনোর সময় ধরুন জানতে পারলেন পরিচারিকা আসছে না, বা হঠাৎ না বলে কয়ে কাজ ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। তাহলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে তো? ব্যস্ত জীবনে সংসারের দায়ভার নিশ্চিন্তে যাঁদের কাঁধে ফেলে কর্মজীবনে মন দেওয়া যায়, তাঁদের জীবন কেমন হয়? তাঁদের লড়াই, গল্প কেমন হয় কখনও ভেবেছেন? 'লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল' যেন এই প্রশ্নগুলোর টুকরো জবাব দিল। 

শহরের বুকে থাকা তিনটি পরিবার। জুটি বলাই ভাল। এঁদের প্রত্যেকের বয়স আলাদা, জীবনধারা আলাদা, সমস্যা, সবই এক অন্যের থেকে আলাদা। তাও, কোথাও গিয়ে এই তিনটি গল্প যেন একই সুতোয় গাঁথা। উৎপল (কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়) ব্যাঙ্কের কেরানি, তাঁর স্ত্রী লাবণ্য (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত)। বিয়ের ৩০ বছর পরেও তাঁদের প্রেম অটুট। কিন্তু উৎপল অবসর নেওয়ার ঠিক আগেই ঘটে যায় এক বিপর্যয়। অন্যদিকে আধুনিক যুগের অল্পবয়সি জুটি হিসেবে দেখা যায় দীপ (জন ভট্টাচার্য) এবং তিয়াসা (রাজনন্দিনী পাল)-কে। তাঁরা লিভ-ইন করে। তাঁদের জীবনে আবার অন্য সমস্যা। অনির্বাণ (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত) এবং রঞ্জাবতী (সঙ্গীতা সিনহা)-কে তৃতীয় জুটি হিসেবে দেখা গিয়েছে এই ছবিতে। এই তিন বাড়িতে যথাক্রমে কাজ করতে লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে আসে কল্যাণী, সরস্বতী এবং মালতী। ওরফে পাওলি দাম, সায়নী ঘোষ এবং চান্দ্রেয়ী ঘোষ। এই তিনজনের বন্ধুত্বের হাত ধরে কোথাও গিয়ে যেন জুড়ে যায় তিন বাড়ি। বিভিন্ন জটিলতার মধ্যে দিয়ে ছবির চরিত্ররা এগিয়ে চলে, এবং শেষ পর্যন্ত কী পরিণতি হয় তাঁদের সেটা জানার জন্য ছবি দেখতে হবে। 

'লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল' দেখে প্রথমেই যে কথাটা মাথায় আসতে বাধ্য, এতদিন কেন কেউ ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়কে জুটি হিসেবে ভাবেননি? হ্যাঁ, 'দৃষ্টিকোণ' ছবিতে অল্প সময় তাঁদের পর্দা ভাগ করতে দেখা গিয়েছে। তবে, এই ছবিতে কী দুর্দান্ত তাঁদের বোঝাপড়া, অনস্ক্রিন রসায়ন। যেন পাশের বাড়ির মধ্যবয়সী কাপল। যে দৃশ্যে জীবনের সবথেকে বড় শোক পেয়ে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের মাথায় ধীরভাবে হাত রাখতে দেখা যায়, সেই দৃশ্য অজান্তেই চোখের কোণ ভিজিয়ে দেয়। সঙ্গে ইমন চক্রবর্তীর কণ্ঠে 'সোনা বন্ধু রে' যেন দৃশ্যটিতে এক অন্য মাত্রা যোগ করে। এই দৃশ্যে কেবল ঋতুপর্ণার অভিনয় নয়, সমানভাবে নজর কাড়েন পাওলি দাম। তাঁর ওই কান্নার ক্লোজ শট দর্শকদের বহুদিন তাড়া করে বেড়াবে। গোটা ছবি জুড়েই তাঁর চরিত্রের পরত, অভিনয় অসাধারণ। 

বহু বছর পর বড়পর্দায় ফিরেই ভাল লাগার ডাবল ডোজ যেন ছবিতে জুড়ে দিলেন সায়নী ঘোষ। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ চেনা, হাসি খুশি মেজাজটাই ছবিতে উঠে এসেছে। চমকে দিয়েছেন তিনি তাঁর নাচের জাদু দেখিয়ে! সায়নীর এই রূপ অকল্পনীয়। অভিনেত্রী যে অসাধারণ নৃত্যশিল্পীও বটে, সেটা যেন এই ছবি বুঝিয়ে দিল। ছোট্ট পরিসরে ভাল লাগে দেবাশিস মণ্ডল এবং রানা বসু ঠাকুরকে। অন্যদিকে মার্জিত, মানিয়ে গুছিয়ে চলা আয়ার চরিত্রে চান্দ্রেয়ী ঘোষ যথাযথ। একটি দৃশ্যে যখন সঙ্গীতা-ইন্দ্রনীলের সন্তান তাঁকে 'মাম্মাম' বলে ডেকে ওঠে, তাতে তাঁর প্রতিক্রিয়া মনে রাখার মতো। এই অনুভুতির সঙ্গে বোধহয় প্রতিটি মা নিজেদের মেলাতে পারবেন। 

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তর চরিত্রে যতটুকু করণীয় ছিল তাতে তিনি প্রাণ ঢেলে দিয়েছেন। সঙ্গীতা সিনহা নিজ চরিত্রে যথাযথ। ইন্দ্রনীলের মতো একজন তুখোড় অভিনেতার বিপরীতে ওঁর কাজে পরিশ্রমের ছাপ স্পষ্ট। 

অল্প একটু দৃশ্যে মদন মিত্র হয়েই ধরা দিয়েছেন বিধায়ক। আর তাতেই নজর কেড়েছেন তিনি। বলা যায়, তাঁর উপস্থিতি এবং সঙ্গে সায়নীর কণ্ঠে তাঁর বলা 'ওহ লাভলি' এই ছবির মধ্যে এক টুকরো মন ভাল করা দমকা বাতাস।

মানুষের গল্প বলতে গিয়ে গোটা ছবি জুড়েই পরিচালক ছোট ছোট নানা অনুভূতিকে তুলে এনেছেন। ভাল লাগার, ভালবাসার, অভিমান, কষ্ট,.... প্রতিটি অনুভূতি যেন নিপাটভাবে বুনেছেন তিনি ছবির পরতে পরতে। বাড়ির পরিচারিকাদের সঙ্গে গৃহকর্ত্রী বা বাড়ির লোকজনদের যে বোঝাপড়া, যে নির্ভরতা তৈরি হয়, সেই বাস্তবতার ছোঁয়া রয়েছে গোটা ছবি জুড়েই। 

ছবিতে থাকা গানগুলোর মধ্যে সোনু নিগমের কণ্ঠে 'তুই যে আপন' গানটির সুর এতটাই সুন্দর, যে অজান্তেই সেটা গুনগুন করে ফেলা যায়। 'মেঠো পথ'-এর সুরে যেন সত্যিই মাটির গন্ধ লেগে। তবে প্রতিটি গানকে ছাপিয়ে গিয়েছে ইমন চক্রবর্তীর কণ্ঠে 'সোনা বন্ধু রে'। আলাদাই দরদ দিয়ে গেয়েছেন তিনি এই গানটি। কিন্তু 'দিল হি কা তুফান'  গল্পের মাঝে খানিকটা খাপছাড়া।

টেকনিক্যাল বিষয়ে কথা বলতে গেলে, এই ছবির একাধিক দৃশ্যের ক্যামেরার কাজ মনে রাখার মতো। কৌশিক সেনের শেষ দৃশ্য হোক বা পাওলি দাম এবং ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর নৌকার দৃশ্য অসাধারণ লেগেছে। কিংবা শেষ দৃশ্যে সায়নী, দেবাশিস, চান্দ্রেয়ীদের ফিরে যাওয়ার দৃশ্যে ক্যামেরার কাজ প্রশংসনীয়। সবটা মিলিয়েই বলা যায় এই ছবিতে লক্ষ্মীকান্তপুর লোকালের মতো ছন্দ, গতি রয়েছে। 

গল্পে কোথাও ফুটে উঠেছে গৃহকর্ত্রী এবং পরিচারিকা থেকে 'বোন', ভরসা হয়ে ওঠার ছবি, কোথাও আবার 'বাইরের একজন' হয়েও একটা ভাঙতে থাকা পরিবারকে অজান্তেই জুড়ে দেয় এই পরিচারিকাই। গোটা ছবি জুড়েই পরিচালক রামকমল মুখোপাধ্যায় যেন এক মানবিক রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। রোজকার জীবনে পরিচারিকাদের উপর কতটা নির্ভরশীল হতে হয়, তাঁরাও সেই চাপ কীভাবে সামাল দেয়, তাঁদের নিজেদের জীবনের সমস্যা, জটিলতা সবটাই ধরা পড়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র কি সবসময়ই এমনটাই হয়? না বোধহয়। পরিচারিকার হাতে খুন, চুরির ঘটনার মতো নানা হেডলাইন কিন্তু নজরে আসে। তারপরেও ইতিবাচক সুরে শেষ হওয়া এই ছবি বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে যেন ভাল লাগার এক টুকরো দমকা বাতাস, যা মন ভাল করবেই। ভাটিয়ালি সুরে কীভাবে যেন পরিচালক 'আমরা-ওরা'র বিভেদ ঘুচিয়ে দিয়েছেন।

তবে ‘সব ভাল যার শেষ ভাল তার'-এর রেশ টেনে একথা বলাই যায়, ‘লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল' মন ছুঁয়ে গিয়েছে। কত নম্বর পেতে পারে এই ছবি, এই তুল্যমূল্য বিচারে যেতে ভাল লাগে না যখন, ছবির শেষে ভাল লাগার রেশ থেকে যায়। একান্তই যদি সেই বিচার করতেই হয়, পরিবারের সবার সঙ্গে বসে দেখা এই ছবিকে দশে এ সাত দিতেই হবে।