স্পাই থ্রিলারের রাজত্বে কোন নতুন স্বাদ নিয়ে এল ‘বার্লিন’? দেখলেন পরমা দাশগুপ্ত। 

 

প্রত্যেকটা মানুষই নিজের গল্পে রাজা হতে চায়। জীবন তাকে যেদিকেই নিয়ে যাক না কেন, রাজা সাজার খিদেয় অন্তত চায় গল্পের সুতোটুকু থাক তার হাতেই। কিন্তু গল্পের সেই সুতো যদি একটানে নাড়িয়ে দিতে চায় দেশের অতিথির নিরাপত্তা? নড়েচড়ে যায় গোটা দেশের সুরক্ষা ব্যবস্থাটাই।

স্পাই থ্রিলারের রাজপাটে হাজির আর এক নতুন কাহিনি। জি ফাইভের নতুন ছবি ‘বার্লিন’। অতুল সবরওয়ালের ছবি অবশ্য দেশপ্রেমের চেনা ছকে হাঁটেনি। ১৯৯৩-এর ভারতে রুশ প্রেসিডেন্টের সফরের ঠিক আগে তাঁকে হত্যার ছক ফাঁস হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বরং তুলে ধরেছে সরকারি ইন্টেলিজেন্স দফতরের দুই শাখার গৃহযুদ্ধের এক অচেনা স্বাদের আখ্যান। আর তার নেপথ্যে? সেই রাজা সাজার খিদে!

বার্লিন। জার্মানির ঝাঁ-চকচকে শহর নয়। রাজধানী দিল্লির কেন্দ্রে সুরক্ষা দফতর, দূতাবাস, ইন্টেলিজেন্স দফতরের বিভিন্ন শাখার ঘেরাটোপে থাকা এক ক্যাফে। অবস্থানের কারণেই নানা গোপন আলোচনা, রাজনীতি, চুক্তি কিংবা দেনাপাওনার সাক্ষীও বটে। সেখানেই কাজ পায় মূক ও বধির অশোক (ইশওয়াক সিং)। তার মতো অনেকেই এখানে গোপন আলোচনার মাঝে দেওয়ালের ভূমিকায় নিযুক্ত।

অনাথ অশোক স্কুলের ফুটবল দলে সুযোগ পেতে চাইত রোজ। নেহাত কেউ করুণা না করলে তার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ত না। ওই যে রাজা সাজার খিদে! তাতেই পরবর্তীকালে ক্যাফের ‘দেওয়াল’ হয়ে সে জড়িয়ে পড়ল রুশ প্রেসিডেন্টের হত্যার ষড়যন্ত্রে। স্পাই সন্দেহে তাকে তুলে নিয়ে গেল ইন্টেলিজেন্স শাখা ব্যুরো। এবং মূক ও বধির অশোককে জেরা করতে গিয়ে নাজেহাল চিফ অফিসার জগদীশ সোন্ধি (রাহুল বোস) সে কাজে নিয়োগ করলেন নেহাতই সাদাসিধে স্কুলশিক্ষক, সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ বিশেষজ্ঞ পুশকিন বর্মাকে (অপরাশক্তি খুরানা)। 

জেরার কাজে সাহায্য করতে গিয়ে পুশকিনের চোখে একটু একটু করে ধরা দিচ্ছিল ইন্টেলিজেন্সের দুনিয়া, তার রাজনীতি, লড়াই আর ফাঁকফোঁকরের চোরাগলি। সেটাই বাড়িয়ে দিল উৎসাহ। নিজের গল্পে রাজার সাধ যে তারও! অশোকের জেরা আর ষড়যন্ত্রের তদন্ত এর পরে তার হাত ধরে কোন পথে এগোয়, সেটাই এ ছবির গল্প।

শুরুতে টানটান এগিয়ে চলা কাহিনি পরের দিকে বেশ কিছুটা গতি হারায়। একটানা সংলাপে, কুচো কুচো দৃশ্যে ঠাসা তথ্য, তদন্তের ক্লু — মনোযোগ না দিলে খেই হারিয়ে ফেলাও বিচিত্র নয়। তবে শেষ পাতে যে চমকটা রাখা, তার জন্য বাকি সব মাফ! আর স্রেফ স্পাই থ্রিলারের রহস্যে আটকে না থেকে জেরার হাত ধরে অশোক আর পুশকিনের মধ্যে গড়ে উঠতে থাকা নিখাদ বন্ধুত্বও মন কাড়ে। যেমন চোখ টানে তিন দশক আগের সময়কালকে ধরা কিংবা ইন্টেলিজেন্স-এর কর্মপদ্ধতির ছোট্ট ছোট্ট ডিটেলিংয়ে পরিচালকের মুন্সীয়ানা। সিপিয়া টোনে নাইন্টিজকে ছোঁয়ার স্বাদটাও বেশ লাগে।        

অপরাশক্তি জাত অভিনেতা। কমেডি থেকে বেরিয়ে আমজনতার ভিড়ে মিশে থাকা এক্কেবারে সাধারণ শিক্ষক থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠা এক চরিত্রে নিজের সেরাটা নিংড়ে দিয়েছেন তিনি। ইন্টেলিজেন্সের শানিত বুদ্ধিমত্তা থেকে ক্ষমতাদখলের ক্রূরতায় রাহুল যথারীতি অনবদ্য। তবে নায়ক যদি কেউ হয়ে থাকেন, তিনি ইশওয়াক। মূক-বধির চরিত্র, যার জীবনে হতাশা, আকাঙ্ক্ষা, প্রেম, ঈর্ষা, সাহস, আত্মত্যাগ- সব মিলেমিশে ফুটিয়ে তোলা সহজ নয়। ইশওয়াক সেখানে ফুলমার্কস সহ পাশ!এক্কেবারে রাজার মতোই!