কেমন কাটল শুভশ্রী গাঙ্গুলির অনুসন্ধান-পর্ব? হইচইয়ের নতুন সিরিজ দেখে লিখছেন পরমা দাশগুপ্ত। 

 


‘রক্ষকই ভক্ষক’। প্রবাদে বলে। ক্লিশে, তবু বাস্তবেও ফলে। তবে যত সহজে মুখে ফেলা যায়, বাস্তবে এমনটা ঘটলে তাকে প্রমাণ করাটা ততটাও সহজ নয়। কারণ, রক্ষকরূপী সেই ভক্ষকেরা ক্ষমতা কিংবা অর্থবলে অনায়াসে ঢাকাচাপা দিয়ে রাখে নিজেদের কীর্তিকলাপ। কেউ তাকে আলোয় আনতে চাইলে যেনতেনপ্রকারেণ তার মুখ বন্ধ করে ফেলাটাই দস্তুর। ঢাকা পড়ে থাকা সত্যিগুলোকে সামনে আনতে, পদে পদে বিপদের সঙ্গে বুক চিতিয়ে লড়ে যেতে চাই অসীম সাহস আর প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার মতো বুদ্ধির জোর। তেমনই এক সাহসিনীর কাহিনি এ বার ওটিটি-র পর্দায়। হইচই-এর নতুন সিরিজ ‘অনুসন্ধান’-এ। যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সাংবাদিকের চরিত্রে আরও এক বার নিজেকে ভাঙলেন শুভশ্রী গাঙ্গুলি। গ্ল্যামার-মোড়া নায়িকার একেবারে উল্টো মেরুতে দাঁড়িয়ে নিজেকে ফের চেনালেন নতুন করে। 

 

 

গল্পের শুরুতে দেখা যায়, রূপপুর মহিলা সংশোধনাগারে তুমুল অত্যাচারের শিকার সাংবাদিক অনুমিতা সেন (শুভশ্রী)। খুনের দায়ে কারাবাস কালে, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় একদিকে সে যেমন দুই কয়েদি নেত্রী আম্মাজান (অরিজিতা মুখোপাধ্যায়) এবং বিলকিস বেগম (স্বাগতা মুখোপাধ্যায়ের) গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার, তেমনই জেল সুপার ভিক্টর পাকড়াশীরও (সাগ্নিক) রোষের মুখে। সমান্তরালে দর্শক ফ্ল্যাশব্যাক টাইমমলাইনে জানতে থাকেন অনুমিতার অতীত কাহিনি। জনপ্রিয় ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট অনুমিতাকে সে সময়ে তার অফিস পাঠিয়েছিল ওই জেলে বন্দি প্রবল প্রতিপত্তিশালী রাজনৈতিক নেতা নারায়ণ সান্যাল (সাহেব চট্টোপাধ্যায়)-এর সাক্ষাৎকার নিতে। সঙ্গে ফোটোগ্রাফার ভোম্বল (অরিত্র দত্তবণিক)। তখনই আচমকা তাদের সামনে এসে পড়া এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলা কয়েদির আর্তনাদে অনুমিতা জানতে পারে, তাকে গর্ভপাত করাতে জোরাজুরি করা হচ্ছে। কৌতূহল বশে বিষয়টা নিয়ে তলে তলে খোঁজখবর শুরু করে সে। আঁচ করে বড়সড় কোনও ষড়যন্ত্র চলছে সংশোধনাগারের অন্দরেই। এদিকে, সাক্ষাৎকার চলাকালীন নারায়ণের কিছু বক্তব্যও প্রচ্ছন্ন হুমকির মতো শোনায়। ইতিমধ্যে কর্মসূত্রে অনুমিতার হবু স্বামী অর্ণবের (হানি বাফনা) হাতে আসে ভয়ঙ্কর কোনও ভিডিও। তার জেরে বড় কোনও বিপদ আসতে পারে, এমনটা সাবধান করার মুহূর্তেই ঘটে যায় ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। অনুমিতা গুরুতর আহত হয়, অর্ণব চলে যায় কোমায়। কেন এই পরিণতি হল অর্ণবের? কী ছিল সেই ভিডিওয়? সংশোধনাগারের রহস্যভেদ কি করতে পারবে অনুমিতা? কেনই বা খুনের দায়ে বন্দি হতে হল তাকে? সব প্রশ্নের উত্তর পেতে সিরিজটা দেখতে হবে। 

 

 

প্রশাসন-রাজনীতির যোগসাজশ, ষড়যন্ত্র-দুর্নীতির জাল কীভাবে, কোথায় ছড়ানো থাকে, সেই সাপের গর্তে হাত দিলে ফল কী হতে পারে, এ সিরিজ তারই গল্প বলে। বাস্তবেও চারপাশে এমন উদাহরণ কম তো নয়! অনুমিতাকে কোণঠাসা করতে চাওয়া বিপদগুলো তাই যেন পর্দা ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে সেই ভয় চারিয়ে দিতে চায়। আবার একইসঙ্গে দেখিয়ে দেয়, বুকের পাটা আর নাছোড় জেদ ঠিক কতদূর নিয়ে যেতে পারে। নেপথ্যে নিঃসন্দেহে পরিচালক অদিতি রায় এবং কাহিনি-সংলাপে সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুন্সীয়ানা।

 


 
সিরিজে চুম্বক শুভশ্রী। ‘পরিণীতা’ থেকে সাম্প্রতিক ছবি ‘গৃহপ্রবেশ’, গত কয়েক বছরের সফরে প্রতিটা চরিত্রে নিজেকে ভেঙেছেন, আবার গড়েছেন। এ ছবিতেও ডি-গ্ল্যাম লুকে, সাধারণ সালোয়ার কামিজ-কুর্তিতে তিনি এক্কেবারে পাশের বাড়ির মেয়ে। তেমনই বেপরোয়া সাহস, হার-না-মানা জেদের সাংবাদিক অনুমিতাকে পুরোদস্তুর বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন অভিনয়ের বলিষ্ঠতায়। সেয়ানে সেয়ানে টক্কর দিয়ে ঠিক এর উল্টো পিঠে সাহেব। শীতল চাহনিতে, পরিশীলিত ক্রূরতায় সাহেব এর আগেও নেগেটিভ চরিত্রে চোখধাঁধানো অভিনয় করেছেন। নারায়ণ সান্যালও সেই পথে হাঁটল। দুর্নীতিপরায়ণ জেল সুপারের ভূমিকায় সাগ্নিকও দারুণ। দুই লড়াকু কয়েদি নেত্রীর চরিত্রে চোখ টানেন অরিজিতা ও স্বাগতা দু’জনেই। ছোট্ট দুই চরিত্রে অরিত্র এবং হানিকে ভাল লাগে যথারীতি। তবে আলাদা করে যাঁর কথা বলা জরুরি, তিনি সোহিনী সেনগুপ্ত। খল চরিত্র মিলি মিত্র যে নিজের প্রতিটা ফ্রেমেই সমস্ত আলো টেনে নেবেন, সে কথা আর বলার অবকাশ রাখে না। সংলাপে তো বটেই, স্রেফ চাহনিতেও যে শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়া যায়, তা আরও একবার প্রমাণ করে ছাড়লেন সোহিনী। 

 

 

কিন্তু গোলমাল হয়ে গেল অন্য জায়গায়। মাত্র একুশ-বাইশ মিনিটের সাতটা পর্ব। তাতেই কি গল্প শেষ করতে খানিক তাড়াহুড়ো হয়ে গেল? জমাটি প্লট, তবু কেমন যেন আলগা হাতে বোনা। কোথাও ডিটেলিংয়ের অভাব, কোথাও আবার কোনও চরিত্র তার নির্দিষ্ট ভূমিকায় কেন রয়েছে গল্পে, তার ব্যাখ্যা নেই। বিশেষত, মিলি মিত্র এবং অনুমিতার বসের চরিত্রের ক্ষেত্রে এ কথাটা ভীষণ ভাবে খাটে। আবার অন্তঃসত্ত্বা অনুমিতা নির্বিবাদে উঁচু গেট টপকাচ্ছে, তার উপরে এত শারীরিক অত্যাচার চলছে, অথচ মিসক্যারেজ হল না, এটাও বিস্ময় জাগায়। অনুমিতার উপরে অত্যাচার বা অ্যাকশন দৃশ্যগুলোও মাঝেসাঝে একটু মেকিই লাগে। তা ছাড়া, বড্ড যেন খাপে খাপ বসে যায় গল্প। যখন যে ক্লু প্রয়োজন, ঠিক সময়ে হাতে এসে পড়ে। যখন যে বিপদ ঘটার, ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘটে যায়। টানটান থ্রিলার এত ক্রাইসিস-বিহীন হওয়া কি ভাল?  শেষের টুইস্ট  অবশ্যই বেশ ভাল। তবে ইদানীং ওটিটি-দর্শক হরেক রকম থ্রিলারে অভ্যস্ত। তাই কারও কারও কাছে একটু প্রেডিক্টেবল ঠেকতেই পারে।  

 

 

এর আগে দুরন্ত সব সিরিজ উপহার দিয়েছেন অদিতি ও সম্রাজ্ঞী দু’জনেই। তাঁদের কাছ থেকে তাই এই খামতিগুলো প্রত্যাশিত ছিলনা। সিরিজের শেষে পরবর্তী সিজনের ইঙ্গিত রয়েছে। তাতে তাই ফের এই জুটিকে চেনা ফর্মে পাওয়ার আশা রইল দর্শক হিসেবে।