উদ্দালক
রাজনৈতিক নাটক কাকে বলে, তা নিয়ে বিস্তর তত্ত্ব আছে। কিন্তু মোটের উপর এটা বলা চলে, সময় ও সমাজের ব্যাখ্যায় যে নাটকে উল্লেখযোগ্য উক্তি থাকে, সেটিই রাজনৈতিক নাটক। সবসময় সেটি অ্যাজিটপ্রপ হতে হবে, তা মোটেই নয়। এই কারণটা সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন রাজ্যের পূর্ববর্তী বামফ্রন্ট সরকার। যে সময়ের কথা হচ্ছে, সেই সময়ে রাজ্যজুড়ে জমি আন্দোলনের ঝড় চলছে। ঠিক সেই সময়ে জমির অধিকার আন্দোলনের অংশ হিসাবে মনোজ মিত্র অভিনীত বাঞ্ছারামের বাগান ছবিটি দেখানো হচ্ছিল। একদিন হঠাৎই সেই সিনেমা প্রদর্শনের সময় হাজির হলেন তৎকালীন শাসকদলের কর্মীরা। বললেন, এটা এখন দেখানো যাবে না।
কেন? বাঞ্ছারামের বাগান-তো একেবারে পারিবারিক একটি ছবি, কোনও অশ্লীলতা নেই, নেই তেমন কোনও আপত্তিকর কথাও। তবু দেখানো বন্ধ করা হল। কারণ, জমি আন্দোলনের মুহূর্তে জমি দখলের জবরদস্তিকে নগ্ন করে দেয়, এমন নাটক দেখানো যাবে না। মঞ্চ, পর্দা উভয়েই সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে যাওয়া অসামান্য এই সৃষ্টিকে ফের একবার মঞ্চে নিয়ে এসেছে অশোকনগর নাট্যমুখ সংস্থা। তাঁদের আয়োজনে নাটকের নাম পাল্টে হয়েছে 'আবার বাঞ্ছা'।
আরও পড়ুন: শিকড়ে ডানার খোঁজে; রতন থিয়াম
মনোজ মিত্রের 'সাজানো বাগান'-নাটকটি বাংলা নাটকের ইতিহাসে এক মাইল ফলক। যতবার বাংলা নাটকের ইতিহাস ফিরে পড়া যাবে, ততবারই এই নাটকের কথা মনে পড়তে বাধ্য। সেই নাটকই এতবছর পর মঞ্চে ফিরিয়ে এনেছেন পরিচালক অভি চক্রবর্তী। অশোকনগর নাট্যমুখের পরিচালনায় রাজ্যের নানাপ্রান্তে, হাজার-হাজার মানুষের সামনে অভিনীত হচ্ছে এই নাটক। উল্লেখ্য, এই নাটক আর পাঁচটা প্রযোজনার থেকে আলাদা, কারণ এই নাটকের হাত ধরে বাংলা রঙ্গমঞ্চ পেয়েছে এক নতুন অভিনেতাকে। একদিকে তিনি বিধায়ক, জেলার সভাধিপতি, অন্যদিকে তিনি অভিনেতা। অশোকনগর বিধানসভা এলাকার বিধায়ক নারায়ণ গোস্বামী এই নাটকে বাঞ্ছার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। মঞ্চে তাঁকে দেখলে বোঝার উপায় নেই, তিনি পেশাদার অভিনেতা নন। দেখে বোঝার উপায় নেই, তিনি বাকি হাজার কাজের ফাঁকে অভিনয়ের আত্মাকেও নিজের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছেন, সেই কারণে সংলাপে ও শরীরে তিনি অনবদ্য।
এই প্রজন্মের অনেকেরই মনোজ মিত্র অভিনীত 'সাজানো বাগান' নাটকটি দেখার সুযোগ হয়নি। তার চেয়ে অনেক বেশি লোক বাঞ্ছারামের বাগান সিনেমাটি দেখেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই মনোজ মিত্রের নির্মাণ ও গড়ন মনে স্থায়ী ভাবে বসে থাকা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু সেই দৃশ্যকল্প ও ভাবনার ছাপ থেকে বেরিয়ে এসে একটা স্বতন্ত্র স্বর তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে এই নাটকটি। অশোকনগর নাট্যমুখের পরিচালক অভি চক্রবর্তী দৃশ্যকল্পে ও অভিনয়ের প্রকারে সেই পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন। পাশাপাশি, তাঁরা নাটকটিকে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, যাতে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে এই সময়ের কথাই বলছে এই নাটক। আসলে মনোজ মিত্র লিখিত এই নাটক এখনও এতটাই প্রাসঙ্গিক, তাকে সময়ের কাছাকাছি করতে ধরতে অসুবিধা হয়নি পরিচালকের।
আরও পড়ুন: দা-এর কোপে কাটছে গলা, কাটছে হাত! রক্তে ভাসা ‘বাগী ৪’-এর প্রথম ঝলক কি টপকে গেল ‘অ্যানিম্যাল’কেও?
মূল চরিত্রে নারায়ণ যেন অনবদ্য তেমনই তার পাশাপাশি অনবদ্য অভিনয় করেছেন অরূপ গোস্বামী, শ্রেয়া সরকার, অসীম দাস, গৌতম বসু, সুপর্ণা চক্রবর্তী-রা। ছোট চরিত্রেও নজর কেড়েছেন গোবিন্দ সরকার ও রিচিক বাগচী। এমন নাটকে প্রবণতা থাকে স্টাইলাইজ অভিনয়ের। সেই প্রবণতাকে কাটিয়ে শ্রেয়া, সুপর্ণা আর গৌতমের অভিনয় আলাদা করে নজরে পড়েছে, মাটির কাছাকাছি থেকেছে মঞ্চে তাঁদের চলন। মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনায় অসামান্য দক্ষতার নজির রেখেছেন অভি চক্রবর্তী। মঞ্চকে তিনি আড়ে ও বহরে বিভিন্ন স্তরে, বিভিন্ন প্রেক্ষিতে ব্যবহার করেছেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই ব্যবহার হয়ে উঠেছে যথাযোগ্য।
মনোজ মিত্রের দক্ষতা তাঁর লেখনিতে বারংবার ঝরে পড়েছে। বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন গোষ্ঠীর সমস্যা ও রাজনীতিকে তিনি ধরেছেন সহজ, সামাজিক গল্পের মধ্যে দিয়ে। আসলে বাংলা সাহিত্যের ধারাই তো এমন, যেখানে 'রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরেও সে ধন আছে'-এর মাধ্যমে আশ্চর্য এক সাম্যবাদী সমাজের কথা বলা হয়। তেমনই সাধের বাগান জোতদারের হাত থেকে রক্ষা করতে করতে বাঞ্ছা কখন বলে ফেলেন আজীবনের জল-জঙ্গল জমির অধিকারের কথা, কখন বলে ফেলেন জমি আন্দোলনের কথা, সেটা হয়ত সরাসরি বোঝা যায় না, কিন্তু সেই কথা প্রভাব ফেলে যায় দীর্ঘমেয়াদী।
