দেখতে দেখতে ১৩ বছরে পা রাখল স্বর সম্রাট ফেস্টিভ্যাল। দেশের অন্যতম সেরা এই রাগ-সঙ্গীতের উৎসবে অংশ নেন প্রাজ্ঞ পন্ডিত-উস্তাদরা। এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। ১২,১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর তিন দিন ধরে নজরুল মঞ্চে চলল স্বর সম্রাট উৎসব। এবারের উৎসব অভিনব যুগলবন্দি এবং পরিবেশনায় সেজে উঠেছিল।
এবারের অন্যতম আকর্ষণ ছিল কবিতা কৃষ্ণমূর্তি (কণ্ঠশিল্পী),সুজাতা মহাপাত্র (ওড়িশি নৃত্য), তন্ময় বোস (তবলা)-এর সমবেত পরিবেশনা। সম্ভবত ভারতে এমন পরিবেশনা এই প্রথম। কবিতা কৃষ্ণমূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে বলেন, "আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিল্পী নই, এখানে যাঁরা অনুষ্ঠান করতে এসেছেন তাঁরা সবাই দিকপাল। আমি নিজে একজন সাধারন মানুষ হতে পারি, কিন্তু এই সমস্ত অসাধারন শিল্পীদের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, এঁদের জন্যই আমার জীবনপথে চলাটা আসাধারণ হয়ে গেছে। কলকাতা আমার কাছে পুণ্যভূমির মতো, আমি নিশ্চয়ই আগের জন্মে বাঙালি ছিলাম।"

প্রতি বছর স্বর সম্রাট ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করেন এই সময়ের অন্যতম সরোদশিল্পী পদ্মশ্রী পন্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার এবং তাঁর পরিবার। দায়িত্বে শ্রী রঞ্জনী ফাউন্ডেশন। তেজেন্দ্র নারায়ণের গুরু স্বর সম্রাট আলি আকবর খানের নামেই এই উৎসবের নাম।
পন্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণের কথায়, "আলি আকবর খান কী বিরাট মাপের শিল্পী তা পরিমাপ করার ক্ষমতা আমার নেই! ওঁর নামে এই উৎসব, আমি চাইব রাগ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান আরও বেশি বেশি করে প্রচার পাক। স্বর সম্রাট ফেস্টিভ্যাল শুধুমাত্র দিকপাল শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করে না, নবীন প্রতিভাদের সব সময় সুযোগ দিয়ে এসেছে এই উৎসব। আমার ধ্রুব বিশ্বাস এই নবীন শিল্পীরাই একদিন দিকপাল হয়ে উঠবে। এবারেও অনেক নবীন শিল্পী তাঁদের প্রতিভা মেলে ধরার সুযোগ পেয়েছেন"।

তেজেনবাবু আরও জানান যে এই উৎসব বরাবরের জন্য মিস করবে উস্তাদ জাকির হোসেনকে। আগের বছর স্বর সম্রাট-এ অংশ নেওয়ার দিনই তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। অন্যান্য বছরের মতো এবারেও এই উৎসবে উপস্থিত ছিলেন গুণী শিল্পীরা। পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী, পন্ডিত এল সুব্রহ্মম, পন্ডিত স্বপন চৌধুরী, মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী, দেবাশিস কুমার এবং আরও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে জমজমাট ছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।
তিন দিনের অনুষ্ঠানে ছিল শিল্পীদের চাঁদের হাট। উস্তাদ জাকির হুসেনকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন উস্তাদ তফিক কুরেশি (ডিজেম্বে), পন্ডিত বিক্রম ঘোষ (তবলা), পন্ডিত রাকেশ চৌরাশিয়া (বাঁশি) সহ আরও অনেকে। ছিল পন্ডিত উল্লাস কশলকর (ভোকাল), সুরেশ তলওয়ালকরের (তবলা) সমবেত অনুষ্ঠান। বিশেষ আকর্ষণ ছিল সমন্বয় সরকার (সেতার) এবং অভিষেক লাহিড়ির (সরোদ) সেতার-সরোদ যুগলবন্দি, পন্ডিত রাজেন্দ্র গঙ্গানি (কত্থক) এবং বিদুষী রমা বৈদ্যানাথন (ভারতনাট্যম)-এর কত্থক-ভারতনাট্যম যুগলবন্দি।
শেষ দিনে এই অনুষ্ঠান দর্শককে মুগ্ধ করে দেয়। এছাড়াও শেষ দিনের চমক ছিল পন্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার (সরোদ) এবং পন্ডিত স্বপন চৌধুরীর (তবলা) অনুষ্ঠান। তেজেন্দ্র নারায়ণ জানান, স্বপন চৌধুরীর জন্যই উস্তাদ আলি আকবর খানের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটে। স্বর সম্রাট ফেস্টিভ্যাল বরাবর নতুনদের সুযোগ দিয়ে এসেছে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পন্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণের ছাত্ররা এক সুন্দর অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন, পরিচালনায় ছিলেন তেজেন্দ্র নারায়ণের ছেলে ইন্দ্রায়ুধ মজুমদার। শীতের সন্ধ্যায় ধ্রুপদী সঙ্গীতের ওমে তিন দিন ধরে মজে ছিল গোটা কলকাতা।
